আবদুল মতিন ডালিম :
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে লক্ষী আসন নামে পরিচিত কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) সংসদীয় আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়াই করছেন আলোচিত সাংসদ আব্দুর রহমান বদির স্ত্রী শাহিন আক্তার চৌধুরী। তাঁর প্রতিপক্ষ ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়ছেন বিএনপির প্রবীণ প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরী। এ আসনে মূলত এ শীর্ষ দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। দলীয় কর্মী-সমর্থকের মধ্যে উৎসাহ আর নির্বাচনী উত্তাপ বিরাজ করলেও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সাধারণ ভোটারের মাঝে পুরোদমে বইছে ভোটের আমেজ। পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রাস্তা-ঘাট পর্যন্ত প্রার্থীদের নিয়ে চলছে কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের আলোচনার ঝড়।
কক্সবাজার জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে- কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) সংসদীয় আসনে ৬ জন প্রার্থী প্রতীক বরাদ্দ নিয়েছেন। এরা হলেন- আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সাংসদ বদির স্ত্রী শাহীন আক্তার চৌধুরী (নৌকা), বিএনপির প্রার্থী ও সাবেক সাংসদ শাহজাহান চৌধুরী (ধানের শীষ), জাতীয় পার্টির মাস্টার আবুল মনজুর (লাঙ্গল), বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সাইফুদ্দিন খালেদ (হারিকেন), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মোহাম্মদ শোয়াইব (হাতপাখা) ও ইসলামী ঐক্যজোটের রবিউল হোসাইন (মিনার)।
এদিকে প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থী পুরোদমে প্রচারণায় নেমে পৃথকভাবে গণসংযোগ, কর্মীসভা, পথসভা ও উঠান বৈঠকে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বর্তমানে এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৬৬ হাজার ১৪৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩৪ হাজার ০১ জন, নারী ভোটার ১ লাখ ৩২ হাজার ১৪৫ জন। এ আসনের মোট ভোট কেন্দ্র ১০০টি। এর মধ্যে উখিয়া উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে ৪৫টি কেন্দ্রে মোট ভোটার ১ লাখ ২০ হাজার ৩৩৮ জন। টেকনাফ উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ৬টি ইউনিয়নে ৫৫টি কেন্দ্রে মোট ভোটার ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮০৮ জন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নির্বাচনী প্রচারে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগের নবীণ প্রার্থী শাহীন আক্তার চৌধুরী ও বিএনপির প্রবীন প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরী। নির্বাচনী এলাকাজুড়ে এ দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর পোস্টার, মাইকিং, গণসংযোগ, কর্মীসভা ও পথসভা চোখে পড়ার মতো।
জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী আবুল মনজুর ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী মোহাম্মদ শোয়াইব এর পোস্টার বেশ কিছু জায়গায় চোখে পড়লেও অন্য প্রার্থীদের প্রচারণা দেখা যাচ্ছে না।
ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উখিয়া-টেকনাফের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গণসংযোগকালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও আলোচিত সাংসদ আবদুর রহমান বদির সহধর্মিনী শাহিন আক্তার চৌধুরী বলেন- টানা দুই মেয়াদে আ’লীগ সরকারের ১০ বছরের শাসনামলে উখিয়া-টেকনাফে প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। এই এলাকার মানুষ উন্নয়ন চাই। তাই এই আসনের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে অতীতের মত উখিয়া-টেকনাফের জনগণ নৌকায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে লক্ষী আসনটি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিয়ে আ’লীগকে তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করবেন।
টেকনাফ সরকারি কলেজের ছাত্রী রাবিয়া সুলতানা জানান- দেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের কারা মেরেছে তা যেমন মনে রেখেছি, তেমনি তরুণদের হাতে স্মার্ট ফোনসহ ডিজিটাল বাংলা বিনির্মাণে কাদের অবদান রয়েছে তাও সকলের জানা আছে। তরুণদের ভোট এবার নীরব বিপ্লব ঘটাবে বলে তরুণ এই ভোটারের অভিমত।
উখিয়ার রতœাপালং ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল ইসলাম বলেন- মাদকের কারণে আমাদের অপবাদ সহ্য করতে হচ্ছে । ভয়াবহ মাদকের অপবাদ থেকে মুক্ত করতে মাদক নির্মূলে যিনি ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে হয়, তাকেই ভোট দেব।
টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লম্বাবিল এলাকার প্রবীন ভোটার আবুল হাসেম বলেন- সব দলের অংশগ্রহণে এবারের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এখানে যোগ্য ব্যক্তিকেই আমরা ভোট দেব।
উপজেলা বিএনপির বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা অভিযোগ করে বলেন- গত ১৩ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের নয়াপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন সাইক্লোন সেন্টারে বিএনপির প্রার্থীর কর্মীসভা চলাকালে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ২৫জন নেতা-কর্মীকে আটকের ঘটনায় বিএনপির মধ্যে গণহারে গ্রেফতারের ভয় ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একই দিন সন্ধ্যা ৬টায় বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে উপজেলার হ্নীলা বাসষ্টেশনে বিএনপির অস্থায়ী নির্বাচনী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক এডভোকেট হাসান ছিদ্দিকী অভিযোগ করেন বলেন- টেকনাফ মডেল থানার পুলিশ অতি উৎসাহী হয়ে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের মোট ২৫জনকে আটক করে নির্বাচনী পরিবেশ বিনষ্ট করেছে। তিনি আরো বলেন, বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এবং জনগণ যাতে বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারে সেজন্য এ ধরণের গ্রেফতার ও মামলা দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস বলেন- পুরনো মামলায় ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কোন রাজনৈতিক পরিচয় আমার জানা নেই।
এছাড়া গত ১৩ ডিসেম্বর বাহারছড়া ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের কর্মীরা শীলখালী চৌকিদার পাড়ায় ২’শত পোস্টার ছিড়ে পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।
বিএনপির প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরী উখিয়া-টেকনাফে গণসংযোগ ও পথসভায় বলেন- আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদির স্ত্রী। তার পক্ষে বদি প্রতিবাদ সভার নামে এপর্যন্ত ২০ থেকে ২৫টি নির্বাচনী জনসভা করেছেন।
গণসংযোগকালে বিএনপির প্রার্থী আ’লীগ সরকারের দুঃশাসনের কথা উল্লেখ করে ভোটারের দ্বারে দ্বারে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করেন।
এব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শাহীন আক্তার চৌধুরী বলেন- স্বামী স্ত্রীর পক্ষে কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক। স্বাধীনতার পর থেকে এই আসনে আমিই একমাত্র নারী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছি। আমার পক্ষে জন¯্রােতে বিএনপির প্রার্থী দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন।
এদিকে আওয়ামী লীগের নবীণ প্রার্থী শাহীন আক্তার চৌধুরী ও বিএনপির প্রবীন প্রার্থী শাহজাহার চৌধুরী পুরোদমে প্রচার প্রচারণা চালালেও হেভিওয়েট দুই প্রার্থী ও তাদের কর্মীদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে নির্বাচনী এলাকায় উত্তাপের সঙ্গে ছড়াচ্ছে উত্তেজনাও। উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুশল বিনিময় ও দোয়া চেয়ে নিজ নিজ প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করছেন হেভিওয়েট এ দুই প্রার্থী। শীর্ষ দুই রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর মধ্যে মূলত হাড্ডাহাড্ডি ভোটের লড়াই হবে বলে সাধারণ ভোটারদের অভিমত।
রাজনীতিতে নতুন হলেও রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে শাহীন আক্তার চৌধুরী স্বামী সাংসদ বদি ও তার বাবা মরহুম ঠান্ডা মিয়া চৌধুরীর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলতে পারবেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে শাহজাহান চৌধুরী একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। জনপ্রিয়তার দিক তিনিও কম না। এদিক থেকে হেভিওয়েট দুই প্রার্থীর জন্য ভোটের লড়াই খুব সহজ হবে না বলে অনেকের অভিমত।
উল্লেখ্য যে, অবিভক্ত রামু-টেকনাফ-উখিয়া আসনে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আ’লীগের প্রার্থী ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী এবং ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরী নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এসে উখিয়া-টেকনাফ নিয়ে আসনটি পুনর্বিন্যাস হয়।ওই নির্বাচনে আবদুল গফুর চৌধুরী, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরী, ১৯৯৬ সালে আ’লীগের প্রার্থী অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরী নির্বাচিত হন।
নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন আবদুর রহমান বদি । তিনি টানা ১০ বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংসদ থাকাকালীন সময়ে নানা বিতর্কের জন্ম দেন । তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। তার পরিবর্তে স্ত্রী শাহিন আক্তার চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-