ডেস্ক রিপোর্ট:: দেশে মাদকের আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে সমন্বিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের নতুন আইন হয়েছে। গত ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর নতুন আইন অনুযায়ী বিধিমালা প্রণয়নের কাজও চলছে।
১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ব্যাপক পরিবর্তন করে সময়োপযোগী এই নতুন আইনটি করা হলো।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী, সারা দেশে ঝুলে থাকা মাদক মামলার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে প্রতিটি জেলায় ‘মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করা হবে। মাদকের সব মামলার তদন্ত ও বিচার ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করারও নির্দেশনা রয়েছে আইনে। ইয়াবার সব উপাদানকে ‘ক’ শ্রেণির মাদক হিসেবে চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত শাস্তির বিধান করা হয়েছে। সম্প্রতি আলোচিত মাদক এনপিএস বা ‘খাত’কেও মাদকের তালিকায় রাখা হয়েছে এবং সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। ব্যাপকভাবে সমালোচিত সিসাকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সিসা বার স্থাপনে লাইসেন্স লাগবে এবং নির্ধারিত পরিমাণের বেশি উপাদান বা অবৈধ ব্যবহারে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
মাদক কারবারিদের অবৈধ সম্পদের কারণে মানি লন্ডারিং মামলা দায়ের এবং পৃষ্ঠপোষকদেরও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে। এই আইন অনুযায়ী, সব সংস্থা মাদকদ্রব্য পরীক্ষাগার ব্যবহার করতে পারবে, যা আগে শুধু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) করত।
আইন অনুযায়ী মাদকসংক্রান্ত অপরাধ দমনে সব নাগরিককে সহযোগিতায় বাধ্য থাকতে হবে।
এদিকে মাদক নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিএনসি দীর্ঘদিন ধরেই অস্ত্রসহ ‘এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির’ স্বীকৃতি চাইছে, নতুন আইনে তাদের সে মর্যাদা দেওয়া হয়নি।
ডিএনসির মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ জামালউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘অনেক কাঙ্ক্ষিত আইনটি অনুমোদন হয়ে গেছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়েছেন। এখন আমরা কয়েকটি বিধিমালা তৈরির কাজ করছি। আগের আইনে অনেক বিষয়ে সমস্যা ছিল। এখন মাদকবিরোধী কার্যক্রম আরো বেগবান হবে। ’
মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন : গত জুলাই মাস পর্যন্ত ডিএনসির এক হিসাবে দেখা গেছে, সারা দেশে তিন লাখ ১৬ হাজার ২৭টি মামলা বিচারাধীন। এক বছরে এক লাখের বেশি মামলা হয়েছে। মামলাজটের কারণে মাদক কারবারিদের বিচার হচ্ছে না। ঝুলে আছে অনেক মামলা। এ সমস্যা সমাধানে নতুন আইনে সরকারি গেজেট বা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ‘মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল’ স্থাপন করতে পারবে। প্রতিটি ট্রাইব্যুনালে অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বিচারক নিযুক্ত হবেন। কোনো জেলায় অতিরিক্ত জেলা জজ না থাকলে দায়রা জজ অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এই ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব পালন করবেন। আইনের ৪৪ ধারার ৪ উপধারায় আরো বলা হয়েছে, কোনো জেলায় ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা অতিরিক্ত জেলা বা দায়রা জজ অতিরিক্ত ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব পালন করবেন।
দ্রুত তদন্ত শেষ করতে হবে : নতুন আইনের ৩১ ধারা অনুয়ায়ী মাদকদ্রব্যসহ আসামি ধরা পড়লে আদালতে সোপর্দ করার ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে এবং আসামি ধরা না পড়লে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। তদন্ত কর্মকর্তা এতে ব্যর্থ হলে কারণ উল্লেখ করে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিবেন। এ জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এবং আদালতে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরবর্তী প্রতিবেদন দিতে হবে। এরপর যদি নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় তাঁকে আসামিসহ মামলা ১৫ দিন এবং আসামিহীন মামলা ৩০ দিনে তদন্ত শেষ করতে হবে।
দ্রুত বিচার শেষ করার বাধ্যবাধকতা : নতুন আইনের ৫১ ধারা অনুযায়ী, ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা পাওয়ার ৯০ কার্যদিবসের মধ্য বিচার শেষ করতে হবে। এটি সম্ভব না হলে আদালত পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে কারণ উল্লেখসহ বিচারকাজ শেষ করবেন। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টকে লিখিতভাবে জানাতে হবে এবং এর অনুলিপি সরকারকে পাঠাতে হবে। একইভাবে আরো ১৫ দিন সময় বাড়াতে পারবেন ট্রাইব্যুনাল।
মানি লন্ডারিং আইনের প্রয়োগ : মাদক কারবারে জড়িত ব্যক্তিদের অর্থ, সম্পদ ও ব্যাংকের হিসাব ও আয়কর খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে আইনের ৩৩ ধারায় উল্লেখ করা হচ্ছে। মাদক কারবার করে অর্জিত সম্পদ অবৈধ নির্ধারণ করে মানি লন্ডারিং আইন-২০১২ অনুযায়ী হিসাব যাচাই ও পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এবং আদালতে আবেদন করবেন।
এদিকে নতুন আইনের ৪০ ধারায় কোনো ব্যক্তি মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত অপরাধে অর্থ বিনিয়োগ করলে, অর্থ সরবরাহ করলে, সহায়তা করলে বা পৃষ্ঠপোষকতা করলে তিনিও দণ্ডের মুখোমুখি হবেন।
সব সংস্থা পেল রাসায়নিক পরীক্ষার সুযোগ : ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী ডিএনসির নিজস্ব পরীক্ষাগার ছাড়া অন্য কোথাও জব্দকৃত মাদকের আলামত পরীক্ষার আইনগত সুযোগ ছিল না। তবে ২০১৮ সালের নতুন আইনের ৬২(খ) ধারায় বলা হচ্ছে, ‘সরকারি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠানকে রাসায়নিক পরীক্ষাগার হিসেবে নির্ধারণ করিতে পারিবে। ’ এর ফলে বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব পরীক্ষাগারেও মাদকদ্রব্য যাচাই করে দেখা যাবে।
সহযোগিতার ধারা : আইনটির ৬৬ ধারা অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের ওপর মাদকসংক্রান্ত ব্যাপারে ডিএনসিসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘এ আইনের কোনো বিধান কার্যকর করিবার ব্যাপারে এবং তথ্য বিনিময় করিবার ব্যাপারে কোনো ব্যক্তি অনুরুদ্ধ হইলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত অফিসারগণকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা করিতে বাধ্য থাকিবেন। ’
এনফোর্সমেন্ট স্বীকৃতি পেল না ডিএনসি, মেলেনি অস্ত্র : প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় ডিএনসিকে মাদকবিষয়ক অপরাধ দমনে পুলিশের মতোই একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা (এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি) হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এ জন্য অস্ত্রসহ প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বিধির মাধ্যমে নির্ধারণের কথা বলা হয়। প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়, ‘মাদক অপরাধ দমন সম্পর্কিত বিষয়ে এই অধিদপ্তর একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা (এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি) হিসেবে গণ্য হইবে এবং উক্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র, পোশাক এবং র্যাংক, ব্যাজ ইত্যাদি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হইবে। ’ তবে সংশোধনের বিভিন্ন পর্যায়ে এ সুপারিশটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে মাদক নিয়ন্ত্রণের মূল সংস্থা থাকলেও আইন প্রয়োগকারী অন্য সংস্থাগুলোর মতো সুবিধা পাচ্ছে না ডিএনসি।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জোর দাবি থাকলেও ডিএনসিকে অস্ত্র প্রদানে পুলিশের ব্যাপক আপত্তি ছিল। এ কারণে আইন-শৃঙ্খলার সমন্বয়ের স্বার্থে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বাতিল রাখে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিএনসিকে আগের মতোই বড় অভিযান চালাতে হলে পুলিশ, র্যাবসহ অন্যান্য সংস্থার সহায়তা নিতে হবে।
সাতটি বিধিমালা : আইনের ৬৮ ধারায় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মাদক আইনের বিধিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়। এর জন্য অ্যালকোহল বিধিমালা, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন, পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা; লাইসেন্স, পারমিট ফি; বাজেয়াপ্তকরণ; ডোপটেস্ট; মাদকাসক্তদের তালিকা ও অফিসার-কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ডিএনসি সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের নির্দেশে অধিদপ্তরকে কার্যকর করতে সাতটি বিধিমালার সঙ্গে পোশাক, অস্ত্র, আটককৃত মাদকদ্রব্য ধ্বংসকরণের বিধিমালা প্রণয়নেরও কাজ হচ্ছে।
আইনের ৬১ ধারার ২-এর খ উপধারায় বলা হয়, সরকার কারাগার, হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্রকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। এ ছাড়া ৩৭ ও ৩৮ ধারা মতে, সরকারি কর্মকর্তার যানবাহনে মালিকের অনুপস্থিতিতে মাদক বহন করলে চালক দায়ী থাকবে এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি কেউ মাদক রাখা বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিজের বাড়িঘর, জায়গাজমি, যানবাহন, যন্ত্রপাতি বা কোনো অর্থ বা সম্পদ ব্যবহার করে, তবে সেও শাস্তির আওতায় আসবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-