নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল নিজ নিজ স্বার্থে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। তৈরি পোশাক খাতে শ্রম নিরাপত্তা মান পরিদর্শনে ইউরোপভিত্তিক ক্রেতা ও শ্রম অধিকার সংস্থার জোট অ্যাকর্ডের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সুযোগ দিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা ইতিমধ্যে সরব হয়েছেন। মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বাতিল করারও হুমকি দিচ্ছেন তাঁরা।
আবার ইউরোপসহ অন্য পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আগে নানা শর্ত জুড়ে দিয়ে সরকার তথা বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য মেরি ক্রিস্টিন ভারজিয়াট গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়ন না করতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ওই চুক্তিকে ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশি এক কূটনীতিক গতকাল শুক্রবার সঙ্গে আলাপকালে এ প্রসঙ্গে বলেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ওই সদস্য যদি প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করেন তাহলে তিনি আসলে কী প্রত্যাশা করছেন? তিনি কী চান, রোহিঙ্গারা নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশেই থাকুক? ইউরোপের দেশগুলো কি তাদের নেবে?
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জটিলতা প্রসঙ্গে ঢাকার কর্মকর্তারা বলেছেন, সাধারণত যত দ্রুত এ সংকট সৃষ্টি হয়, তত দ্রুত কোনোভাবেই সমাধান করা যায় না। এ ধরনের সংকটে আশ্রয় নেওয়া সবাই হয়তো ফিরেও যায় না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) রোহিঙ্গাদের এ দেশে আশ্রয় পাওয়া নিয়ে যতটা সরব ছিল, ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ততটা সরব নয়। যেমন—শরণার্থী বা শরণার্থীর মতো পরিস্থিতিই যদি না থাকে তাহলে এ দেশে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে হবে। শরণার্থী বা শরণার্থীর মতো ব্যক্তিদের আনা ও ফেরত পাঠানো—এ দুটি কাজই মূলত এ ধরনের সংস্থার করার কথা। কিন্তু তারা শরণার্থী আনতে যতটা আগ্রহী, ফেরত পাঠাতে ততটা নয়। এর সঙ্গে তাদের কর্মীদের জীবিকার বিষয়ও জড়িত।
একজন কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এখনো দেশ-বিদেশে অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে যে এনজিও আইনের কারণে তাদের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বিদেশি অনুদান পেতেও সমস্যা হচ্ছে। সরকারের অবস্থান হলো, জঙ্গি অর্থায়নের মতো বিষয় ঠেকানো এবং বিদেশি অনুদানের অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই ওই আইন করা হয়েছে। কাউকে হয়রানি করার জন্য নয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের আগস্ট থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর এনজিওগুলোর মানবিক তৎপরতায় আগ্রহ বেড়েছে। কারণ রোহিঙ্গা শিবিরে এনজিওগুলোর কাজের সৃষ্টি হয়েছে। তবে মানবিক তৎপরতার নামে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার গাড়ি কেনা ও অধিক হারে বিদেশিদের নিয়োগ করা নিয়েও বিভিন্ন মহলে অসন্তোষ রয়েছে।
ad
এদিকে গত বৃহস্পতিবার ফাঁস হওয়া ইউএনএইচসিআরের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে আশ্রয় শিবিরে রাখার মেয়াদ স্বল্প সময়ের না হলে তারা সেখানে কোনো সহযোগিতা দেবে না। সংস্থাটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও এই পথ অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছে।
ইউএনএইচসিআর জোর দিয়ে বলছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। অন্যদিকে ওই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারকে বাধ্য করার মতো আন্তর্জাতিক উদ্যোগও নেই। এখন পর্যন্ত যেসব প্রস্তাব জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে গৃহীত হয়েছে সেগুলোতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েই দায় সারা হয়েছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি না হলে বা ফিরতে আগ্রহী না হলে তারা কি বাংলাদেশেই থাকবে?—এমন প্রশ্নের জবাবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া বা ফিরতে আগ্রহী না হওয়া সাময়িক। এত বিপুলসংখ্যক লোককে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিশ্বে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গত বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং বিভিন্ন ইস্যুতে পার্লামেন্ট সদস্যরা উদ্বেগ জানিয়েছেন। এ দেশের বিরোধী দলগুলোর সুরে তাঁদের উদ্বেগ জানানোর পেছনেও ব্যাপক রাজনৈতিক তদবির কাজ করছে বলে মনে করছেন ঢাকার কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যরা যেভাবে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন ততটা উদ্বেগ স্থানীয় পশ্চিমা দূতাবাসগুলো দেখায় না।
সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, জনপ্রতিনিধিরা পার্লামেন্টে স্বাধীনভাবে বক্তব্য দেন। হয়তো বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের যেভাবে ব্রিফ করা হয়েছে সেটিকেই তাঁরা আমলে নিয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বেলজিয়াম বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক আলম হোসেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর দলের অবস্থান তুলে ধরছেন। এ ছাড়া আরো বেশ কিছু লবিস্ট গ্রুপ তৎপর রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রেও একাধিক তদবিরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিএনপির হয়ে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ওই দেশটির জার্নাল পলিটিকোতে গত ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা বলেছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি বর্তমান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লবিস্ট ফার্ম ‘ব্লু স্টার স্ট্র্যাটেজিস’কে নিয়োগ দিয়েছে। ব্লু স্টারের হয়ে কাজ করবে ‘র্যাস্কি পার্টনার’ নামের আরেক তদবিরকারী প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফিং ও আলোচনা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে টম ল্যানটোস মানবাধিকার কমিশনের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতির জোরালো সমালোচনা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আরো আলোচনা, ব্রিফিং দেখা যেতে পারে। কারণ এগুলোর নেপথ্যে অনেক শক্তি, অর্থ ও তদবির কাজ করছে। সূত্র-কালেরকন্ঠ
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-