সায়ীদ আলমগী, জাগো নিউজ
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের রাচিদং এলাকার বাসিন্দা জহির আহমদ (৫৮)। গত বছরের আগস্ট মাসে মিয়ানমারে সহিংসতা শুরু হলে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি।
আশ্রয় নেন উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া এলাকায়। বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয়ের পর পরিবারের খাবার ও কাজের সুযোগ পান তিনি। কিন্তু এ দিয়ে জীবন চালানো কষ্টের। তাই কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লম্বাশিয়ায় একটি মুদি দোকান দিয়ে বসেন তিনি। বর্তমানে সেখানে দারুণ ব্যবসা জমিয়েছেন জহির আহমদ।
শুধু জহির আহমদ নয়, উখিয়া-টেকনাফের ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা ধরনের পণ্যের প্রায় ২৪-২৫ হাজার প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা চালাচ্ছেন প্রাণ হাতে নিয়ে বাংলাদেশে আসা হাজারো রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পবাসীদের জন্য দোকান-পাট প্রয়োজন আছে ভেবে ক্যাম্পের পাশে সামাজিক বনায়নের গাছপালা কেটে সারি সারি দোকানঘর তুলে ফেলে স্থানীয় সুবিধাভোগী একটি চক্র। সেসব দোকানঘর রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দামে ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।
ছয় সন্তানের বাবা জহির আহমদ বলেন, আরাকানে আমরা সচ্ছল ছিলাম। পরিবারে সবই ছিল। ব্যবসা ও কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতাম। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের অত্যাচারের মুখে হাতে যা ছিল তা নিয়ে পালিয়ে আসি। আসার পর খবর পাই অন্যদের সঙ্গে আমার বাড়িটিও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় প্রতিমাসে নানা পণ্য সাহায্য পাই। এখানে একটি দোকান ভাড়া নিয়েছি। দোকানে ব্যবসা করে ভালোই আয় হচ্ছে। আমার সংসার চলে যায়। তবে আশায় বুক বেঁধে আছি, একটি সম্মানজনক প্রত্যাবাসন হলে নিজ দেশে গিয়ে আগের মতো ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবন চালিয়ে নেব।
হাকিমপাড়া ক্যাম্পের সড়কের পাশে নিজেদের বসবাসের জন্য তৈরি করা বাড়ির চালে আরেকটি চাল লাগিয়ে চা-সিগারেট ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান দিয়ে বসেছেন সেলিম উল্লাহ (৩৫)। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম রাজ্যের ঝিমংখালী এলাকার সেলিম উল্লাহ পরিবারের অনেককে হারিয়ে বাংলাদেশে আসেন। আশ্রয়ে আসার পর থেকে নিয়মিত সহযোগিতা পাচ্ছেন। সেখান থেকে জমিয়ে কিছু জিনিস বিক্রি করে তা দিয়েই দোকান খুলেছেন।
সেলিম উল্লাহ বলেন, আমাদের কষ্টের জীবন। এভাবে বসে না থেকে ভাবলাম কিছু একটা করি। তাই দোকানটি দিয়েছে। বেচাকেনা ভালোই হচ্ছে। চলছে জীবন কোনোমতে। আমরা এভাবে এখানে থাকতে চাই না। সম্মান নিয়ে মিয়ানমারে ফিরতে চাই।
একইভাবে উখিয়ার ময়নারঘোনা, মধুরছরা, বালুখালী-১, ২, ৩ ও ৪ নম্বর ক্যাম্প, বাগঘোনা ও চাকমা পাড়াসহ সবকটি ক্যাম্পের আশপাশে দোকান খুলে বসেছে রোহিঙ্গারা।
এসব দোকানের মধ্যে রয়েছে- মুদিমাল, সবজি, চা-নাস্তা, পান-সিগারেট, কাপড়, প্রসাধনী, সিডি, টিভি, গান ডাউনলোড এবং মোবাইলের ফ্লেক্সিলোডসহ হরেক রকম দোকানপাট। প্রায় প্রতিটি দোকানে গড়ে দৈনিক ৫-৭ হাজার টাকা বিক্রি হয়।
তাদের দেখে অন্য রোহিঙ্গারাও ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেদের জড়াতে চাচ্ছে। কেউ না কেউ প্রতিদিনই নতুন নতুন দোকানপাট খুলে বসছে। ফলে অন্য রোহিঙ্গাদেরও ব্যবসার প্রতি ঝোঁক বেশি।
মধুরছরার ডাবল ‘ও’ ব্লকের সালামত খানের পরিবার বুচিদংয়ের লাউয়াদক এলাকায় বড় গৃহস্থের পরিবার হিসেবে পরিচিত ছিল। ১০-১৫ একর জমি চাষ, ১০-১২টা গরু, নিজস্ব পুকুরে মাছ ও জমি চাষ করতেন। মাধ্যমিক শেষ করা সালামত বাড়তি আয়ের জন্য গ্রামের বাজার ও সচেতন পরিবারগুলোতে জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতেন। এখানেও তার সেটা করতে ইচ্ছে। তবে পুঁজি না থাকা এবং চাহিদার বিষয়ে তেমন জ্ঞান না থাকায় সেটি করতে পারছেন না সালামত। সহসা দেশে ফেরা না হলে আগের ব্যবস্থা এখানে শুরু করতে চায় সালামত।
এদিকে, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য করাকে দেশের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে শহর কিংবা গ্রামে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করতে হলে পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স আবশ্যক। ক্ষেত্র বিশেষে আয়কর সনদসহ নানা অনুমতিপত্র দরকার পড়ে। এগুলো ব্যয়সাপেক্ষ এবং প্রতিবছর নবায়ন যোগ্য হওয়ায় অর্থাভাবে অনেক যুবক ব্যবসার দিকে যেতে পারে না। কিন্তু রোহিঙ্গারা চাইলেই দোকান পাট খুলে ব্যবসা করছে সহজে। তারা আশ্রিত জীবনে এদেশের অর্থ আয় করে নিজ দেশে পাঠালে বা প্রত্যাবাসনের সময় নিয়ে গেলে আমাদের অর্থনীতিতে চাপ পড়বে। এসব বিষয়ে প্রশাসনের নজর দেয়া উচিত।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, মানবিক আশ্রয়ের পর বিশ্বজনমতের সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে কাজ করছে সরকার। এত সংখ্যক লোকজনকে নিয়মিত আহার সংস্থান, নিরাপত্তাসহ নানা বিষয়ে কাজ করছে প্রশাসন। তাই রোহিঙ্গাদের ব্যবসা করা নিয়ে ভাবা হয়নি। তবে এগুলো নজরে রয়েছে। ধীরে ধীরে এসব বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার ঢল নামেন। রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার কথা বলে সে দেশের সেনাবাহিনী ধরপাকড় চালায়। সেখানে নির্যাতন, বাড়িঘরে আগুন ও গণধর্ষণ চালালে রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ঠাঁই নিয়েছে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গার নিরাপদ প্রত্যাবসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। তবে এক বছরেও মিয়ানমারের পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এখনো পর্যন্ত ১ জন রোহিঙ্গা ফিরে যায়নি। বরং রোহিঙ্গাদের আগমন এখনো অব্যাহত আছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-