ডেস্ক নিউজ – বাংলাদেশে যে রোহিঙ্গারা আছেন, তাদের ফেরত নিতে কয়েকদফা বৈঠকের পর এ বছরের শুরুতেই মিয়ানমারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। যেখানে তালিকা অনুযায়ী ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয় মিয়ানমার। বাংলাদেশ থেকে প্রথম দফায় একটি তালিকা হস্তান্তর করলেও পরে সেখান থেকে একজনকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের দুটি সংস্থাও মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। রোববার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের পরিস্থতি পর্যবেক্ষণ শেষে বাংলাদেশে ফিরেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে একধরণের অবিশ্বাস ও সন্দেহ আরো জোরালো হচ্ছে। কেন এই অবস্থা তৈরি হলো?
মিয়ানমারে সাজানো গোছানো সংসার ফেলে এখন বাংলাদেশে ফাতেমা বেগম।
তার এই শরণার্থীর জীবন কতটা দীর্ঘ হবে তা জানেন না তিনি। তবে নিজের থাকার জায়গাটি মনের মতো করে গড়ে তুলতে চেষ্টার কমতি নেই ফাতেমার।
তার সঙ্গে যখন কথা শুরু করবো ঠিক তখনি আকাশ কালো করে নেমে এলো বৃষ্টি।
পুরো ক্যাম্প জুড়ে তখন বৃষ্টি আর বাতাস থেকে বাঁচতে রাজ্যের ব্যস্ততা।
ফাতেমা বেগমও তার নতুন গড়ে তোলা কাঁচা মাটির দেয়াল রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
একসময় বৃষ্টি থামে। কিন্তু ততক্ষণে ফাতেমার তৈরি দেয়াল ভেঙ্গে শেষ। যেভাবে তার দেশে ফেরার স্বপ্নও ভেঙ্গে গেছে বারবার।
”আমরা তো অনেকবারই শুনেছি যে আমাদের ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু ফিরিয়ে নিলেই কি সব শেষ? আমাদের নিরাপত্তা কি থাকবে? একবছর হয়ে গেলো । কেউ তো এখন আর কিছু বলছে না । চুক্তি হচ্ছে নাকি হচ্ছে না সেগুলোও আমরা জানি না।” বলছিলেন ফাতেমা বেগম।
উখিয়ার থাইনখালি ক্যাম্পেই এবার আমি যাই রাশেদা বেগমের কাছে।
তখন মধ্য দুপুর। চুলোয় রান্না হচ্ছে দুপুরের খাবার।
খাবার বলতে অবশ্য একমুঠো ভাত, ডাল আর শুকনো মরিচের ভর্তা। এটাই তার প্রতিদিনের খাবার।
রাশেদা বলছিলেন, ”এখানে আমরা ১০জন থাকি। ১৫ দিনে চাল পাই মাত্র ৩০ কেজি। এতে দুই বেলাও ঠিকমতো খাওয়া যায় না। পাহাড়ের অনেক নিচে থেকে পানি আনতেও খুব কষ্ট হয়। যখন বৃষ্টি হয় তখন পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি ঘরের ভেতর দিয়ে নিচে চলে যায়। ঘুমাতে পারি না কেউই। কিন্তু তবুও মিয়ানমারের চেয়ে আমরা এখানেই ভালো আছি।”
রাশেদার খুপড়ি ঘরের পাশেই সৈয়দ উল্লাহ-নার্গিস দম্পতি অবশ্য মনে প্রাণে ফিরতে চান মিয়ানমারে।
সেখানকার কথা মনে করতেই অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন নার্গিস। মুখে কোন ভাষা নেই।
তার স্বামী সৈয়দ উল্লাহ আশাবাদি দেরি হলেও মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে।
তিনি বলছিলেন, ”একবছর হয়ে গেলো কিন্তু মিয়ানমার এখনো আমাদের নিচ্ছে না। প্রক্রিয়া শুরু হলেই তারা নানান টালবাহানা করে। আমরা যখন এখানে আসি তখন ভাবিনি এতো দীর্ঘ সময় থাকতে হবে। তবে যেহেতু বিশ্বের অনেক দেশ আমাদের পাশে আছে, আমি নিশ্চিত মিয়ানমার আমাদের ঠিকই ফেরত নিতে বাধ্য হবে। তবে নাগরিকত্বসহ আমাদের দাবি-দাওয়া না মানলে কিন্তু আমরা যাবো না।”
সৈয়দ উল্লাহর মত আরো অনেকের সঙ্গেই আমার কথা হয়।
যারা নিজ দেশে ফিরতে চান। কিন্তু ফেরার প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমাণ অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশ।
বাংলাদেশে যে রোহিঙ্গারা আছেন, তাদের ফেরত নিতে কয়েকদফা বৈঠকের পর এ বছরের শুরুতেই মিয়ানমারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ।
যেখানে তালিকা অনুযায়ী ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয় মিয়ানমার।
বাংলাদেশ থেকে প্রথম দফায় আট হাজার বত্রিশ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকা হস্তান্তর করা হলেও পরে আর একজনকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।
কেন এ অবস্থা হলো?
এর উত্তরে অবশ্য বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন মনে করছে, প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারে যে অবকাঠামো দরকার তা এখনো না হওয়াতে এবং রাখাইনে নিরাপত্তা নিয়ে রোহিঙ্গাদের অবিশ্বাসের কারণেই প্রত্যাবাসনে দেরি হচ্ছে।
”ওরা তো বলেছিলো যে, রোহিঙ্গাদের নেয়া শুরু করবে। কিন্তু সেটা তো শুরু করেনি। আসলে মুখে বলা আর বাস্তবে শুরু করা এক না। এটা অনেক জটিল প্রক্রিয়া। সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ, অবকাঠামো নির্মাণ এরকম অনেক কিছুই এর সঙ্গে জড়িত। প্রত্যাবাসনকে নিরাপদ ও টেকসই করারও একটা ব্যাপার আছে। রোহিঙ্গারা তাদের গ্রামে ফিরতে চায়। আর মিয়ানমার চায় আগে কিছুদিন ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখতে। এটা নিয়েও সন্দেহ আছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে।”
”সবকিছু নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করতে মিয়ানমারে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গিয়েছিলেন। তারা রাখাইন সফরও করেছেন। মিয়ানমারের প্রস্তুতি দেখেছেন। আশা করি এই সফরে প্রত্যাবাসন নিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে।” বলছিলেন অতিরক্তি শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামছু-দ্দৌজা।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, গত কয়েক মাসে মিয়ানমারে ফেরার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের অবিশ্বাস আরো বেড়েছে।
এতোদিন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গারা জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা চেয়ে এসেছিলেন।
কিন্তু গত জুনে জাতিসংঘের দুটি সংস্থার সঙ্গে মিয়ানমারের একটি চুক্তি স্বাক্ষরের পর তা নিয়ে নিজেরাই এখন সন্দিহান হয়ে পড়েছেন রোহিঙ্গারা।
এর কারণ জানতে চেয়েছিলাম রোহিঙ্গা সংগঠন ”আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস” এর সভাপতি মুহিব উল্লাহ’র কাছে।
তিনি বলছিলেন, ”আমরা জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, চুক্তিতে কী আছে? কিন্তু তারা আমাদের কিছুই জানায়নি। শুধু বলেছে চুক্তিতে আমাদের ভালো হবে। কিন্তু খবরে দেখছি যে, চুক্তিতে আমাদের নাগরিকত্ব, শিক্ষা বা মুক্তভাবে চলাফেরার মতো বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। তাহলে এভাবে ফেরত গিয়ে আমাদের কী লাভ?”
তবে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর অবশ্য বলছে, মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের চুক্তি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে নিরাপদ ও টেকসই করবে।
সংস্থাটির মুখপাত্র ফাইরাজ আল খতিব আমাকে বলছিলেন,
”এই চুক্তিটা হচ্ছে প্রত্যাবাসনের একটা প্রাথমিক পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে আমরা মিয়ানমারে গিয়ে সেখানকার অবস্থা এবং পুনর্বাসনের প্রস্তুতি যাচাই করতে পারবো। যেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা নিশ্চিত করতে চাই একটা নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন। এবং আমরা সবসময়ই রোহিংগাদের সকল অধিকার রক্ষার চেষ্টা করি।”
ইউএনএইচসিআর কিংবা বাংলাদেশের শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশন সবার বক্তব্যেই এটা পরিস্কার যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হয়তো খুব সহসাই শুরু হচ্ছে না। এবং যখন শুরু হবে তখন তা শেষ হতেও লেগে যেতে পারে দীর্ঘ সময়।
ফলে বলা যায়, রোহিঙ্গাদের অপেক্ষার অবসানও খুব সহসাই শেষ হচ্ছে না।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-