ডেস্ক নিউজ – কক্সবাজারে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ইটভাটার অবস্থান। তার ওপর পাহাড় কেটে সংগ্রহ করা মাটি দিয়ে তৈরি হচ্ছে ইট। জেলায় প্রতিবছর ইট ভাটা থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়ে পরিবেশ দূষণ করছে। এছাড়া এসব ভাটায় বিপুল পরিমাণ ভূ-উপরস্থ মাটি ব্যবহার করায় আশঙ্কাজনক হারে কমছে কৃষিজমি। বিধি নিষেধ অমান্য করে জেলার ৮টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা এসব ইটভাটায় ইট পোড়ানোর ফলে দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র। ওই সব ইটভাটার মধ্যে বেশীরভাগ ইট ভাটা জেলা প্রশাসনের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই ইট পোড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ জানা গেছে।
বছরের পর বছর প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের জ্ঞাতসারে ওইসব ইট ভাটা গুলোতে ইট পোড়ানো হলেও এ ব্যাপারে এমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। মাঝে মধ্যে লোক দেখানো মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মধ্যদিয়ে সীমাবদ্ধ থাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কতিপয় কর্মকর্তা ওইসব অবৈধ ইটভাটা থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। অথচ আধুনিক প্রযুক্তির ইট ভাটা ব্যবহার করে কার্বন নি:সরণ প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক ঘেঁষে রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের মধ্যম খুনিয়াপালং এলাকায় অবস্থিত ইটভাটা । এসব ইটভাটা স্থাপন করতে গিয়ে নষ্ট হয়েছে ফসলী জমি। নিয়ম না থাকা স্বত্বেও গড়ে তোলা হয়েছে বনের পাশে।
চকরিয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে পাহাড় কেটে ইটভাটা স্থাপনরে হিড়িক চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আগে থেকে উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নে মানিকপুর বনবিট ও লামা বনবিভাগের পাইতং বনবিটের অধীন বনবিভাগের একাধিক পাহাড় কেটে সমতল করে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই এসব ইটভাটার কাজ অব্যাহত রয়েছে। চকরিয়া উপজেলার উত্তর হারবাং বনের পাশে ভাটা রয়েছে ৩টি। পেকুয়ায় রয়েছে ২টি। এছাড়াও টেকনাফে ৯টি, রামুতে ১০, সদরে ৪ ইটভাটা রয়েছে।
পরিবেশ আইনে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ থাকলেও বিষয়টি নিয়ে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর ও বনবিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রয়েছে দর্শকের ভুমিকায়।
জেলায় শতাধিক পরিবেশগত ছাড়পত্রবিহীন অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে বনের গাছ।
পরিবেশ আইন অনুসারে, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি ও কৃষিজমিতে ইটভাটা তৈরি করা যাবে না। এছাড়া, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা সদর এলাকায়ও ইটভাটা তৈরি করা যাবে না। অন্যদিকে ইট তৈরির জন্য কৃষিজমি, পাহাড়, টিলা থেকে মাটি কেটে কাঁচামাল হিসেবে এবং জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারও নিষিদ্ধ।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রন আইন ২০১৩ এ বলা হয়েছে, পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের স্বার্থে আধুনিক প্রযুক্তির ইট ভাটা স্থাপন করতে হবে। কৃষি জমি পাহাড় টিলা থেকে মাটি কেটে ইটের কাঁচা মাল হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়া পরিবেশের ছাড় পত্র ছাড়া ইট উৎপাদন করলে অনধিক ১বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ১লক্ষ টাকা অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। ইট ভাটায় জ্বালানী কাঠ ব্যবহার করলে অনধিক ৩বছরের কারা দন্ড বা অনধিক ৩লক্ষ টাকা অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
জেলার বিভিন্ন এলাকায় বাড়ছে ইটভাটা। নিয়মনীতি না মেনেই অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। অবৈধভাবে কৃষি জমিতে ইটভাটা তৈরির কারণে কমছে চাষাবাদের জমি। এছাড়া, ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারে কমছে গাছ।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলার আট উপজেলায় সম্প্রতি জরিপ চালিয়ে ১৩৩ টি ইটভাটার তালিকা তৈরী করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তালিকার বাইরেও অন্তত ৫০ টি ইটভাটা রয়েছে। ১৩৩ টি ইটভাটার মধ্যে প্রায় ১০০ টি ইটভাটারই কোন ধরণের পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। আবার অনেক গুলোর বছরের পর বছর নবায়ন করা হয়নি। সম্পূর্ণ অবৈধভাবে চলছে এসব ইটভাটা।
প্রত্যেক্ষদর্শীরা জানান, বেশীরভাগ ইট ভাটা ফসলী জমি নষ্ট করে গড়ে তোলা হয়েছে। আবার অনেক ইট ভাটায় কয়লার পরিবর্তে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।
স্থানীয়দের মতে, ইটভাটায় কয়লা পুড়ানোর কথা বললেও মূলত রাতের অন্ধকারে গোপনে চুল্লিতে কাঠ ঢুকানো হয়। এসব কাঠ সংগ্রহ করা হয় পাহাড়ি এলাকা থেকে। কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে উজাড় হয়ে যাচ্ছে সামাজিক বনায়নও। এসএসবি ইটভাটার ব্যবস্থাপক মো. আবু তাহেরের সাথে কথা হয় সিভয়েসের। তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে শুরু করে সকল দপ্তরের ছাড়পত্র ও নিবন্ধন রয়েছে বলে দাবী করেন ইটভাটার ব্যবস্থার আবু তাহের। কিন্তু কোন ধরণের বৈধ কাগজ তিনি এ প্রতিবেদককে দেখাতে পারেননি।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রমতে, সম্প্রতি পরিবেশগত ছাড়পত্রবিহীন সাতটি ইটভাটার বিরুদ্ধে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এছাড়াও রামুর কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের ১০টি ইটভাটার বিরুদ্ধে উচ্চআদালতে রীট মামলা করে পরিবেশ আইনবিদ সংগঠন (বেলা)। এই ১০টি সহ পরিবেশ অধিদপ্তর ১১টি ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু নির্দেশনা মানা হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের যে দশটি ইটভাটায় ইট উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়, সেগুলোতে নির্দেশনা অমান্য করে ইট উৎপাদন চালু রয়েছে। এছাড়াও পরিবেশগত ছাড়পত্র বিহীন যত্রতত্র বিদ্যালয়, এলজিইডি সড়ক, ফসলী জমি ও বনের পাশে ইটভাটা গড়ে উঠায় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। আর বনের কাঠ ধ্বংসের পাশাপাশি সামাজিক বনায়নও উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
টেকনাফের হ্নীলা বনাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, পাশাপাশি দূরত্বে দুটি ভাটায় কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি হচ্ছে। ভাটার ৬০-৭০ গজ দূরে লেদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের পাশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দুটি সীমান্ত চৌকি। ভাটা দুটির ৮০ গজের মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ লেদা গ্রাম। টেকনাফের নয়াপাড়া ও জাদিমুরা গ্রামে বনের আধা কিলোমিটারের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে আরো পাঁচটি ইটভাটা।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, বনের আশপাশে অবৈধভাবে তৈরি ইটভাটাগুলো উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসন বরাবরে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না পরিবেশ অধিদপ্তরও। এতে দিন দিন বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, অনেক ইটভাটার চিমনি এখনও উন্নত প্রযুক্তিতে রুপান্তর করা হয়নি। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ ও অতিরিক্তি মাত্রার সালফারযুক্ত কয়লা ব্যবহার হচ্ছে। কাঠ ব্যবহারের ফলে গাছের সংখ্যা কমছে। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। পরিবেশ আইন অমান্য করে অভয়ারণ্য, কৃষি জমি ও আবাসিক এলাকায় রয়েছে ইটভাটা। ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়সহ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ইটভাটার কালো ধোঁয়ার কারণে ফুসফুসের সমস্যা, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগ হতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বয়স্ক ও শিশুরা। ইটভাটার ধোঁয়ায় নষ্ট হয় গাছের ফল ও পাখির আবাস।
কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল বলেন, ইটভাটার কারণে বিশেষ করে বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। কিছু ইটভাটা কয়লা পুড়ানোর কথা বললেও তারাও গোপনে কাঠ পুড়াচ্ছে। ইটভাটার বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট ইটভাটা নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে তা টিকে আছে, সেই প্রশ্ন আমরাও করি।’
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক সাইফুল আশ্রাব বলেন, সম্প্রতি মাঠ পর্যায়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে অবৈধ ইটভাটা গুলো তালিকা করা হয়। বর্তমানেও চলমান। এখন পর্যায়ক্রমে ইটভাটা গুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, অবৈধ ইটভাটা গুলোর মালিককে নোটিশ করা হচ্ছে। এবং চট্টগ্রাম কার্যালয়ে জরিমানার জন্য পাঠানো হচ্ছে। কোন ইটভাটা পরিবেশগতভাবে ছাড়পত্র পাওয়ার যোগ্য না হলে সেগুলো ধ্বংস করে দেয়া হবে। পরে অভৈধ ইটভাটার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করে পরিবেশের ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-