মিজানুর রহমান :
উঁচু পাহাড়ের বুক চিরে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা নদী, ঝিরি থেকে খাল- লোভীদের চোখ পড়েছে সবখানে। ‘পাহাড়ের রানি’ বান্দরবানের এসব জায়গা থেকে নির্বিচারে তোলা হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ- বালি ও পাথর। এতে শুকিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি নদী, ঝিরি, খাল। পানির সংকট দেখা দেয়ায় কমছে চাষাবাদ। বিপর্যয় ঘটছে প্রাণ ও পরিবেশের। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
শুধু বালি-পাথর তুলেই ক্ষান্ত হচ্ছে না স্থানীয় প্রভাবশালীরা, তারা দখল করছে খালের জায়গা। সেখানে নির্মাণ করছে অবৈধ স্থাপনা। বনের গাছ কেটে পাচার করছে কাঠ। উন্নয়নের নামে সাবাড় করা হচ্ছে একের পর এক পাহাড়। প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এসব কাজ হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহরের কাছেই পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় লোকজন ঝিরি-খাল, নদীর তীর দখল করে ঘরবাড়ি তৈরি করছে। এতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ফলে পাহাড়ি শহরেই জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে, দূষণ বাড়ছে। এখন থেকেই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে শহরের অবস্থা আরও খারাপ হবে।
পাথর-বালি উত্তোলনে পরিবেশ বিপর্যয়: থানচিতে গত ১৬ বছরের উন্নয়ন কাজে স্থানীয় ঝিরি, ছড়া, খাল ও নদী থেকে অবাধে পাথর ও বালি উত্তোলন করায় পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। উন্নয়ন কাজের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ- পাথর, বালি উত্তোলন করায় শুকিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি ঝিরিগুলো। যেকারণে পানিসংকট দেখা দিয়েছে। চাষাবাদ কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন স্থানীয়রা।
মাতামুহুরী নদী, পাহাড়ি ঝিরি, খাল, ফসলের মাঠে গর্ত করে অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে লামায়ও। শ্যালো মেশিন দিয়ে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ২৫টির বেশি স্থান থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে পাচার করছেন প্রভাবশালীরা। তবে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন লামার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রূপায়ন দেব।
নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন খাল, ঝিরি ও নদ-নদী থেকেও অবাধে চলছে বালি উত্তোলন। আওয়ামী লীগ-বিএনপির একটি চক্র একজোট হয়ে ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে আসছে সেখানে। বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলম কোম্পানি বাইশারীর ৫-৬টি পয়েন্টে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কথা স্বীকার করে বলেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে জরুরি আইনগত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
বান্দরবানের দুঃখ ম্যাকছি ঝিরি: পাহাড়ি এলাকা হলেও বর্ষায় বান্দরবান শহরে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শহরের পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম ম্যাকছি ঝিরি। এই ঝিরি দিয়েই শহরের পানি ও ময়লা-আবর্জনা বনানী সমিল এলাকায় গিয়ে স্লুইসগেটের মাধ্যমে সাঙ্গু নদীতে পড়ে। তবে ৯০ দশকের পর ঝিরি এলাকা দখল হতে হতে এত ছোট হয়ে গেছে- এখন পানি আর নিষ্কাশিত হয় না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অরূপ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসন, পৌরসভা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে অবৈধ দখলদার ও স্থাপনা শনাক্তের কাজ চলছে। ঝিরির জমি উদ্ধারের পাশাপাশি সাঙ্গু নদীর সংযোগস্থলের স্লুইসগেটের আধুনিকায়ন করতে হবে। জলাবদ্ধতার পানি আধুনিক উপায়ে পাম্পিংয়ের মাধ্যমে সরাতে হবে।
হুমকিতে সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্ট: মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা দেশের দক্ষিণ-পূর্বের গভীর বনাঞ্চল সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্ট। ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ১১ প্রজাতির বিরল পাখির অস্তিত্ব রয়েছে এখানে। তবে অবাধে কাঠপাচার, বন্যপ্রাণী শিকারীদের উৎপাত ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ৫ হাজার ৭৬০ একরের এই অভয়ারণ্য।
বান্দরবান বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গভাবে রিজার্ভ ফরেস্টের জরিপ হয়নি। দুর্গম এলাকা ও লোকবল সংকটের কারণে বিশাল এই রিজার্ভ ফরেস্ট তদারকিতে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, ফরেস্ট থেকে গাছ পাচার দুরূহ। নিরাপত্তা বাহিনী এবং বনবিভাগ সচেষ্ট আছে।
সাবাড় হচ্ছে পাহাড়: দেশে সবচেয়ে বেশি পাহাড়ের সংখ্যা বান্দরবানে। এসব পাহাড় প্রকৃতিতে যেমন অপার সৌন্দর্য এনে দিয়েছে, তেমনি পরিবেশ রক্ষায়ও ভ‚মিকা রাখছে। তবে আবাসিক এলাকা, সরকারি বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য স্থাপনা নির্মাণ, ইটভাটা, কারখানা নির্মাণ ও মাটি বিক্রির জন্য কাটা হচ্ছে এসব পাহাড়। পাহাড় কাটার কারণে ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে বিভিন্ন এলাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত ১০ বছরে বান্দরবান শহরের আশপাশে শতাধিক পাহাড় কাটা হয়েছে। আংশিক কাটা হয়েছে এরকম রয়েছে দেড় শতাধিক। বান্দরবান পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র কেমিস্ট রেজাউল করিম বলেন, জনবল সংকটের কারণে অনেক সময় অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে খবর পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
পরিবেশগত ক্ষতি বাড়াচ্ছে তামাকচাষ: তামাক উৎপাদন ও তামাক শিল্পজাত পণ্যের পরিবেশগত ক্ষতি বহুমাত্রিক। তবে তামাকচাষ ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবসা বন্ধ হয়নি; বরং বেড়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে (রাঙামাটি, বান্দবান ও খাগড়াছড়ি) বিশেষ করে বান্দরবানে টানা কয়েক বছরের তামাকচাষের সরকারি হিসাব তার বাস্তব অবস্থার প্রমাণ দেয়। এতে ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল। হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-