খুলশীতে গোয়েন্দ পরিচয়ে ডাকাতি । তথ্য পায় আনসারী পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজনের কাছে, এক মাস ধরে পরিকল্পনা । রিমান্ডে নানা তথ্য দিয়েছে ১২ জন, জবানবন্দি রেকর্ড করা হতে পারে আজ
চট্টগ্রাম :
নগরীর খুলশীর ফ্ল্যাটে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়া ১২ জন তিন দিনের রিমান্ডে আছে। রিমান্ডে তারা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা যমুনা অয়েল কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আনসারীর বাসায় ডাকাতির পরিকল্পনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই পুলিশের নিকট স্বীকার করেছে। আজ মঙ্গলবার তাদেরকে আদালতে হাজির করে জবানবন্দি রেকর্ড করা হতে পারে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে। মূলত বিশজনের একটি দল গঠন করে ওই বাসায় লুকিয়ে রাখা নগদ ৫৯০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেই তারা হানা দিয়েছিল। ডিজিএফআই পরিচয় দেওয়ার বুদ্ধিও তারা এক মাস ধরে পরিকল্পনা করে ঠিক করেছিল বলে পুলিশকে জানিয়েছে। তারা মনে করেছিল, ওই সংস্থার লোক পরিচয় দিলে কেউ চ্যালেঞ্জ করবে না। অবাধে টাকাগুলো বস্তা ভরে নিয়ে চলে আসতে পারবে। এর আগে বলা হয়েছিল, ওই বাসায় ৫০ কোটি থাকার খবরে ডাকাতদল হানা দিয়েছিল।
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্র জানায়, গত শুক্রবার রাতে দক্ষিণ খুলশীর ৩ নং সড়কের একটি অ্যাপার্টমেন্টে ডাকাতি করতে যায় ২০ জনের একটি দল। দুটি কালো রঙের হাইয়েস মাইক্রোবাস নিয়ে তারা ওই ভবনে পৌঁছে। নিজেদের ডিজিএফআইয়ের লোক পরিচয় দিয়ে তারা তিনজন সিকিউরিটি গার্ডের হাত–পা এবং চোখ বেঁধে ফেলে। ভবনের ইন্টারকম ফোনের সংযোগ এবং সিসিটিভি ক্যামেরার হার্ডডিস্ক নিয়ে নেয়। পরে তারা ওই ভবনের আট এবং নয়তলা নিয়ে ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে গিয়ে দরজা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে। অত্যাধুনিক ফিঙ্গারপ্রিন্টের তালাগুলো খুলতে না পারায় তারা দরজা ভেঙে ৯ তলার দুটি রুমে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। তাদের কাছে খবর ছিল, ওই দুই রুমে ৫৯০ কোটি ক্যাশ টাকা রয়েছে। হাতে অত্যাধুনিক ওয়াকিটকি এবং গলায় ডিজিএফআইয়ের কার্ড ঝুলিয়ে তারা শুরুটা ঠিকভাবে করলেও ভবনের বাসিন্দাদের কেউ একজন ৯৯৯ নম্বরে ফোন করলে খুলশী থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে। এ সময় ডাকাতদলের ৮ জন একটি মাইক্রোবাস নিয়ে পালিয়ে যায়। বাকি ১২ জন ধরা পড়ে। এ ঘটনায় যমুনা অয়েল কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আনসারী বাদী হয়ে খুলশী থানায় মামলা করেন। গ্রেপ্তার ১২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে আসে পুলিশ। গ্রেপ্তার ১২ জন হলো মো. ওয়াজেদ রাকিব (৩৬), মো. হোসাইন (৪২), মো. রোকন (৩৯), মো. ওসমান (৪০), রুবেল হোসেন (২৫), মহিউদ্দিন (৪৫), আবদুস সবুর (৩৭), মো. ইয়াকুব (৩৫), মোজাহের আলম (৫৫), হারুন অর রশিদ (৩৬), আবদুল মান্নান (৩৫) ও শওকত আকবর (২৮)। এদের কেউ সাবেক ব্যাংকার, কেউ বালু সরবরাহকারী, কেউ জমি বেচাকেনার দালালি করে।
গ্রেপ্তারদের গত দুদিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা পুলিশের কাছে অনেক কিছু স্বীকার করেছে। তারা জানায়, এক মাস আগ থেকে তারা জানতে পারে, যমুনা অয়েল কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আনসারীর ফ্ল্যাটে নগদ ৫৯০ কোটি টাকা রয়েছে। সবগুলো এক হাজার টাকার নোট। এক কোটি টাকা ওজনে সাড়ে সাঁইত্রিশ কেজি হয়। তাই টাকাগুলো নেওয়ার জন্য তারা ২৫টি বড় প্লাস্টিকের বস্তাও নিয়ে আসে। আনসারী পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজনের কাছ থেকে তথ্যটি পাওয়ার পর তারা নিজেরা আলোচনা করে, টাকাগুলো হাতিয়ে নিতে পারলেই হবে। এসব টাকার ব্যাপারে কোনো মামলা হবে না। এমনকি আনসারী সাহেব কাউকে বলতেও পারবেন না।
পেশায় বালু সরবরাহকারী ওয়াজেদ রাকিব বিশ্বস্ত সূত্রে টাকার খবর পেয়ে ডাকাতির ঘটনার মাধ্যমে টাকাগুলো হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। গত ৭ জানুয়ারি ওয়াজেদ রাকিব যমুনা অয়েলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আনসারীর ঘনিষ্ঠ একজনের মাধ্যমে ওই ফ্ল্যাটে নগদ ৫৯০ কোটি টাকার খবরটি জানতে পারে। ওয়াজেদ বিষয়টি নিয়ে জমি কেনাবেচার সাথে জড়িত জনৈক মোহাম্মদ মালিক ও ওয়াসিম নামের তার ঘনিষ্ঠ দুজনের সাথে আলাপ করে। পরে তারা তাদের বন্ধু হোসাইন নামের একজনকে দলে ভিড়ায়। হোসাইন বিষয়টি নিয়ে ঘনিষ্ঠজনদের সাথে তাদের কথা বলিয়ে দেয়। পরে মীরসরাইয়ের আলম ও শওকত নামের দুজনও দলে ভিড়ে। এরপর দফায় দফায় বৈঠক করে। নগরীর হালিশহরসহ বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে তারা বৈঠক করে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করেন। সবাই মিলে খুলশীতে এসে অ্যাপার্টমেন্টটি রেকি করে যায়।
আলম তিনটি খেলনা পিস্তল, দুটি ওয়াকিটকিসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলো যোগাড় করে। আলম সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) নকল পরিচয়পত্রগুলো আলম তৈরি করিয়ে আনে। মহিউদ্দিন নামে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তাকেও দলে ভিড়ানো হয়।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে তারা ভবনটিতে হানা দেয়। ওই সময় গিয়াস উদ্দিন আনসারী কিংবা পরিবারের কেউ বাসায় ছিলেন না। পরিবার নিয়ে তিনি কঙবাজারে অবকাশ কাটাতে গিয়েছিলেন। ডাকাতদলের সদস্যরা সুযোগ পেয়ে কিছুটা তড়িঘড়ি করে হানা দেওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে। মূলত বাসা ফাঁকা থাকার খবরটিও তারা বিশ্বস্ত সূত্রে আগেভাগে নিশ্চিত হয়েছিল।
খুলশী থানা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ওই ভবনের তিনটি ফ্ল্যাট নিয়ে ডুপ্লেঙ বাসা বানিয়ে গিয়াস উদ্দিন আনসারীর বসবাস। মাস কয়েক আগে নতুন ফ্ল্যাটটিতে উঠেন তিনি। ফ্ল্যাটে মোট পাঁচটি বেডরুম রয়েছে। প্রত্যেকটি বেডরুম অত্যাধুনিক ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক করা। লকগুলো খুলতে নির্দিষ্ট আঙুলের ছাপ বাধ্যতামূলক। বাসার সকলের আঙুলের ছাপ তাতে দেওয়া থাকে। ওই বিশাল বাসাটিতে স্ত্রী এবং এক কন্যা সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। তার ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। আটতলায় ফ্ল্যাটে প্রবেশের মূল দরজা। ভিতর দিয়ে যেতে হয় নবম তলায়। ৮ম তলায় ড্রয়িংসহ দুটি বেডরুম এবং নবম তলায় তিনটি বেডরুম এবং লিভিংরুম। ডাকাত দল আটতলার মূল দরজা ভেঙে প্রবেশ করে ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে নয়তলায় উঠে দুটি কক্ষের ডিজিটাল ফিঙ্গার লক ভাঙার চেষ্টা করার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।
পুলিশ জানিয়েছে, টাকা ছাড়া ডাকাতদলের অন্য কোনো জিনিসের প্রতি দৃষ্টি ছিল না। তাই তারা ঘরের অন্য কোনো জিনিস ধরেনি। তারা টাকার হদিশ করছিল। কিন্তু ঘর থেকে কোনো টাকা তারা নিতে পারেনি। ফ্ল্যাট মালিক গিয়াস উদ্দিন আনসারী পুলিশকে বলেছেন, ঘরে বাসার খরচের জন্য দুই লাখ টাকা ছিল, তা অক্ষত রয়েছে।
খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মজিবুর রহমান বলেন, গ্রেপ্তারকৃত ১২ জনকে রিমান্ড শেষে আজ আদালতে পাঠানো হবে। তারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। আমরা সবকিছু খতিয়ে দেখছি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-