‘গরীবের ডাক্তার’ হতে চান জাতীয় মেধায় মেডিকেলে উত্তীর্ণ কক্সবাজার’র খালেদ-ইরিন

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার :


‘কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার পাঁচ ইউনিয়ন মফস্বল গ্রাম। এরমাঝে আমাদের গ্রাম জালালাবাদের ফরাজীপাড়া এবং আশপাশের অধিকাংশ গ্রামের মানুষ হতদরিদ্র। এখানে একটা ভালো ক্লিনিকও নেই। হাতেগোনা যে কয়েকটি হাসপাতাল বা ক্লিনিক রয়েছে তা-ও ঈদগাঁও বাজার এলাকায়। অসুখের সময় হতদরিদ্র মানুষগুলোর এতদূরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে ভোগান্তি পোহাতে হয়।

ছেলেবেলা হতে দেখে এসেছি, মোটা অংকের ডাক্তার ফি ও অধিক চিকিৎসা ব্যয়ে দরিদ্র মানুষগুলো ঠিকমতো ওষুধও কিনে খেতে পারেন না। বাবাকে দেখেছি, নিরবে মানুষের সহায় হতে। তাই আমারও ইচ্ছে আল্লাহপাক সুষ্ঠুভাবে চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তুললে আমি এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝে সপ্তাহের বিশেষ দিনে বিনা মূলে চিকিৎসা-সেবা দেব। এক কথায় আমি- ‘গরীবের ডাক্তার’ হিসেবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই।’

সদ্য ঘোষিত মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধা তালিকায় ৭৮তম স্থান নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) পড়ার সুযোগ পাওয়া ঈদগাঁওর জালালাবাদের পূর্ব ফরাজীপাড়ার খালেদ বিন রশিদ প্রতিক্রিয়া ও তার ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা এভাবে ব্যক্ত করেছেন।

খালেদ ঈদগাঁওর পূর্ব ফরাজীপাড়ার ব্যবসায়ী রশিদ আহামদ ও জান্নাতুল মোস্তফা ঝিনুকের একমাত্র ছেলে। তিনি ঈদগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে পিএসসি, কক্সবাজার সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি ও ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ হতে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হওয়ার পাশাপাশি ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় সমগ্র ঢাকা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে খালেদ। পিএসসি ও জেএসসিতে টেলেন্টপুলে মেধাবৃত্তিও অর্জন করেন তিনি।

খালেদের চাচা তরুণ পর্যটন উদ্যোক্তা ও সী বিচ রিসোর্টের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আমানুল হক আমান জানান, খালেদ পড়া লেখার পাশাপাশি প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে স্কুল, থানা, জেলা, বিভাগ এবং জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছ থেকেও পুরস্কার প্রাপ্ত। তার এ সাফল্য নতুন প্রজম্মের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। এলাকার মানুষের সেবায় তার বাবা রশিদ আহমদ ঈদগাঁও বাজারে তাদের একটি ভবনে মা-মনি হাসপাতাল নামে একটি চিকিৎসা সেবালয় পরিচালনায় সম্পৃক্ত। তার একমাত্র বোনও স্নাতক পাশ করেছে।

জালালাবাদ ইউপির ৫নং ওয়ার্ড সদস্য ও খালেদদের প্রতিবেশী নুরুল আলম মেম্বার বলেন, পুরো এলাকার মুখ উজ্জল করেছে খালেদ। আল্লাহপাক তাকে জাতীয়মানের চিকিৎসক হয়ে দেশের চিকিৎসা সেবারমান সম্প্রসারণে অবদান রাখার সুযোগ দিন।

অপরদিকে, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ১৫তম স্থান নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেরিটে ৬৯তম স্থান অর্জন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন চকরিয়ার অজপাড়া গা সাহারবিলের তানহা তাজরিয়া ইরিন। তিনি কক্সবাজার সরকারি কলেজ ও চট্টগ্রামে সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক প্রয়াত মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন ও গৃহিণী এশরাক জাহান জেসমিনের দ্বিতীয় মেয়ে ও তৃতীয় সন্তান। চকরিয়ার শাহারবিল ইউনিয়নের মাইজঘোনা গ্রামের সর্বজন পরিচিত মাস্টার জিন্নাত আলী ইরিনের দাদা।

ইরিন চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় হতে পিএসসি ও ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম বোর্ডে চতুর্থস্থান এবং ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম বোর্ডে ১৫তম স্থান অর্জন করে উত্তীর্ণ হয়। এছাড়াও অষ্টম ও পিএসসিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও লাভ করে ইরিন।

তার বড় বোন জান্নাতুল মাওয়া জেরিন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত। বড়ভাই মুসফিকুর রহমান চুয়েটে মেকানিকেল ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ ফাইনাল বর্ষে ও ছোটভাই মশিউর রহমান আরাফ চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। দাদাবাড়ি চকরিয়ার সাহারবিলে মাইজঘোনায় হলেও বাবার চাকরিকালীন সময় হতে তাদের বর্তমান স্থায়ী আবাস চট্টগ্রামের চকবাজার মিয়ারবাপের বাড়ি এলাকায়।

ইরিনের মা এশরাক জাহান জেসমিন বলেন, ২০১৬ সালে ইরিন যখন চতুর্থ শ্রেণীতে তখনই তাদের বাবা (প্রফেসর সাইফুদ্দিন) অকস্মাৎ স্ট্রোক করে মারা যান। তার ইচ্ছে ছিল সন্তানদের দেশের কল্যাণে বড় করবেন। আমাদের স্বজন, স্বামীর সহকর্মীদের আন্তরিক সহযোগিতায় প্রতিকূল নানা বিষয়ের সাথে যুদ্ধ করে সন্তানদের বাবার চাওয়া মতো মানুষ করার চেষ্টা করছি। বড় মেয়ে চিকিৎসক হয়ে বের হবার পথে। বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। মেঝ মেয়েটা ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছে। ছোট ছেলেটাও এসএসসি দেবে আগামীবার। তাকে একটি গতি করে দিতে পারলে মনে হবে অসময়ে স্বামীর চাপিয়ে দেয়া বোঝা আমি সঠিক ভাবে বহন করতে পেরেছি, তখন আমার দায়িত্বশেষ।

জাতীয় মেধায় ৬৯তম স্থানে উত্তীর্ণ হয়ে ঢামেকে ভর্তির সুযোগ ও ভব্যিষত পরিকল্পনা বিষয়ে তানহা তাজরিয়া ইরিন বলেন, আমার বাবা ও দাদা সমাজকে আলোকিত করতে অনেক অবদান রেখে গেছেন। তাদের মেয়ে ও নাতনী হিসেবে এলাকায় সবার ¯েœহ এখনো পাচ্ছি। তাদের সেই ধারা অব্যহত রাখতে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হয়ে এলাকার অবহেলিত মানুষদের সেবা দেয়ার ইচ্ছে আমার। মানবিক ডাক্তার হয়ে বাবা-দাদা ও মায়ের মুখ উজ্জল করতে চাই। আল্লাহর কৃপা, মা ও শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় আমি ঢামেকে পড়ার সুযোগ পেয়েছি।

উল্লেখ্য, গত ১৯ জানুয়ারী সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় ফল প্রকাশিত হয়।

আরও খবর