মো. তাওহীদুল ইসলাম রাপী :
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ও ইসলামী ব্লগার লেখক শাফিউর রহমান ফারাবী। লিখালিখির কারণেই যাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপ ছিল কঠিন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। ১৯৮৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর থানাধীন কালাইশ্রীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা, ফেরদৌসুর রহমান, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরডিবি) উপ-পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সালে বাবার মৃত্যু এবং শৈশবেই মা উম্মে সালমা শেলীকে হারানোর পর থেকেই জীবনের প্রতিকূলতা তাঁকে ঘিরে ধরে।
সৎমায়ের ঘরে বেড়ে ওঠা ফারাবীর জীবনে পারিবারিক উষ্ণতার অভাব ছিল। সৎমা ও সৎবোন থাকা সত্ত্বেও তাদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি। তাঁর মামলাগুলোর দিকেও কেউ নজর দেয়নি। এমনকি হাসিনার নির্মম, নিষ্ঠুর কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে কারাবন্দী অবস্থায় বাবাকে হারানোর পরও পরিবার থেকে কোনো সাড়া পাননি।
ফারাবী কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে পঞ্চম শ্রেণি, ২০০১ সালে কেন্দুয়া জয়হরি স্কাই সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, এবং ২০০৫ সালে ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তবে মাতৃহীন শৈশবের মানসিক চাপ এবং দুই বছরের মানসিক চিকিৎসার কারণে তাঁর পড়ালেখায় বাধা সৃষ্টি হয়।
২০০৫-২০০৬ সেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে ফারাবী উচ্চশিক্ষার পথে এগিয়ে যান। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানোর প্রতিবাদে আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে তিনি ২৪ শিক্ষার্থীর সঙ্গে গ্রেপ্তার হন এবং এক মাস জেলহাজতে কাটান। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে তিনি লেখালেখি এবং ব্লগিংয়ের মাধ্যমে ইসলাম নিয়ে নিজের ভাবনা ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকেন।
তার সংগ্রামী জীবন এবং লেখালেখি তাঁকে সাহসী ইসলামপন্থী লেখক হিসেবে পরিচিত করেছে। তবে পারিবারিক এবং সামাজিক সমর্থনের অভাবে তিনি মানবেতর জীবনযাপন করেছেন, যা তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা ও সংকল্পকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।
শাফিউর রহমান ফারাবী একজন সাহসী এবং প্রতিবাদী স্বভাবের মানুষ। তিনি সবসময় অন্যায় ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালীন সময়ে তিনি বিভিন্ন সামাজিক এবং অরাজনৈতিক সংগঠনে যুক্ত ছিলেন। তাঁর কণ্ঠ ছিল সবসময় বিপ্লবীদের পক্ষে এবং দেশের স্বার্থে তিনি সব ধরনের ষড়যন্ত্র ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। বিশেষ করে, ফ্যাসিবাদী সরকার এবং ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার সরব অবস্থান তাকে দেশপ্রেমিক ও নির্ভীক হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।
ফারাবী অনলাইনে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় উগ্র হিন্দুত্ববাদ ও নাস্তিকদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন। যা পরবর্তীতে তার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায়, তিনি বারবার ফ্যাসিবাদী সরকারের রোষানলে পড়ে গ্রেপ্তার হন, যা তার উচ্চ শিক্ষা জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।ফলে শেষ পর্যন্ত স্নাতক আর শেষ করা সম্ভব হয়নি এ মেধাবী ছাত্রের।
ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগার রাজীব (থাবা বাবা) হত্যাকাণ্ডের পর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে ফারাবী গ্রেপ্তার হন। তবে তার লেখালেখি মূলত ইসলামিক চিন্তাচেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, যা তাকে ইসলামপন্থী মহলে জনপ্রিয় করে তোলে। তিন-চার বছর ধরে তিনি বিভিন্ন ব্লগে ইসলামিক বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতেন।
ঠিক সে সময়ে রকমারী ডট কম নামের অনলাইন বই বিক্রির প্রতিষ্ঠানটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এটির মালিক ঐ সময়ে নাস্তিক থাকায় এটি বিশেষ করে নাস্তিকদের লিখা ইসলাম বিদ্বেষী বইগুলোকে প্রচার করতে শুরু করে। এই বইগুলোর প্রচারের ফলে বইয়ের বিক্রি বেড়ে যায় এবং সাধারণ শিক্ষিত সমাজকে এসব বিপজ্জনক ইসলাম বিদ্বেষী বই থেকে রক্ষা করতে ফারাবী নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে প্রতিবাদ শুরু করেন। তিনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা নাস্তিকদের বই প্রচার করার বিরুদ্ধে রকমারী ডট কমের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। ফারাবীর আপোষহীন আন্দোলনের ফলে রকমারি ডট কম বাধ্য হয় সেইসব বই সরিয়ে নিতে।
তার প্রতিবাদী মনোভাবের কারণে নাস্তিক ব্লগারদের সাথে তার ধর্মীয় মতপার্থক্য তীব্র হয়। থাবা বাবা (ব্লগার রাজীব), আসিফ মহিউদ্দিন, অভিজিৎ রায়, তসলিমা নাসরিন, দাড়িপাল্লা ধমাধম, দিগম্বর-পয়গম্বর, সানতুনু মহাপাত্র, অগ্নিবীণ, আল্লামা শয়তান (মশিউর রহমান), সানতুনু আদিম, প্যানগান দেবতা এবং হিন্দু যোদ্ধা নামক ব্লগারদের সঙ্গে তাঁর ধর্ম নিয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। তারা ইসলামবিরোধী চিন্তাচেতনার প্রচার করায় ফারাবী তাদের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছিলেন।
ফারাবির প্রথম আইনজীবী অ্যাডভোকেট রাহিল আব্দুর রহমান বলেছেন, ইসলাম ও ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য ফারাবি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের কাছে যেতো। কখনো চরমোনাই, কখনো শিবির, কখনো হেফাজত। প্রচন্ড জ্ঞানপিপাষু ছিল। সে ছিল হোসাইন আহমদ মাদানির ভক্ত।
ভারতের দেওবন্দের সূর্য সন্তান হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)। যিনি ছিলেন উপ মহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। ব্রিটিশরা ভারতীয় নেতাদের অনেক সময় রাজনীতি ও ধর্মীয় কারণে গ্রেপ্তার করত এবং তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করত। এমনই এক ঘটনায়, হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-কে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সেই সময় মাদানি (রহ.) রানী ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলায় জবানবন্দী দিচ্ছিলেন, সেখানে তিনি এক অনবদ্য বক্তব্য দিয়েছিলেন।
তিনি আদালতে বলেন, “আমরা ভারতীয়রা একজন মুসলমান হিসেবে, ব্রিটিশ রাজের অধীনে থাকতে পারি না। আমরা স্বাধীনতা চাই, আর আমাদের স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছি। রানী ভিক্টোরিয়া, তোমার রাজত্বে থাকতে আমরা সম্মতি জানাই না। তোমাদের পক্ষে ভারত শাসন করার কোনো অধিকার নেই।”
তার এমন জ্বালাময়ী বক্তব্য ব্রিটিশদের মনে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল।গোটা ভারতবর্ষ তার এই বক্তব্য তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল।
তার এই আদর্শেই অনুপ্রাণিত ছিল।ফারাবী, ফারাবীকে যখন কোর্টে তুলা হয় সেখানে তিনিও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি জবান বন্দি দিয়েছিলেন….তিনি বলেছিলেন নাস্তিকরা মূলত পোকামাকড়ের মতো।হাসিনা মূলত এই রাষ্ট্রকে একটি নাস্তিক রিপাবলিক স্টেইট হিসেবে তৈরি করতে চাই।তাই এসব নাস্তিক দের তিনি তার ছায়াতলে আশ্রয় প্রশ্রয়ে দিয়ে লালিত করেন।২০২৩ সালের ৩০ জানুয়য়ারি তথ্য প্রযুক্তি আইনের মামলার রায়ের দিন কোর্ট প্রাঙ্গণে ফারাবী গণমাধ্যমকে বলেন…
প্রত্যেকটা বিষয় নিয়েই সে পড়াশোনা করত ফারাবী । ইসলামপন্থী ব্লগার ফারাবী ইসলাম বিরোধী লেখালেখির জবাব দিতেন এবং ধর্মের পক্ষে যুক্তি নির্ভর আলোচনা করতেন। তার কর্মকাণ্ড ছিল যুক্তির পিঠে যুক্তি দাঁড় করিয়ে গঠনমূলক বিতর্ক করা।
শাহবাগ আন্দোলনের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যখন নাস্তিকরা একের পর এক ইসলাম বিদ্বেষী কথা ও রাসুল (সা.) নিয়ে কটুক্তি করছিল, তখন তাদের নাস্তক্যবাদীদের গোমর ফাঁস করে শাহবাগের সেই আন্দোলনকে নাস্তিকদের আন্দোলন দাবী করে প্রমাণ করেছিলেন যার ফলে তাদের সমস্ত উদ্দেশ্য নস্যাৎ হয়ে যায়।যেখানে লক্ষ লক্ষ জনতার ভীড় পড়ে থাকত ফারাবির লিখালিখির পর সেই শাহবাগে সঙ্গ দেওয়ার মতো।লোকজন পাচ্ছিল না নাস্তিক ব্লগার রা।তাই তাদের সেই আন্দোলনের বিরোধিতা করে ধর্মপ্রাণ মানুষ নিয়ে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে ফেঁসে উঠেছিলেন হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ। যার ফলস্রুতিতে সেদিন হেফাজতের হাজার হাজার নিরিহ মুসলিমদের হত্যা করেছিল হাসিনা সরকার।
এসব নাস্তিকদের কটুক্তির বিরুদ্ধে চুপ থাকতে পারেননি ফারাবি। তখন এই সময়ের জনপ্রিয় লেখক আরিফ আজাদরা ছিলেন না। কিন্তু এই এক ফারাবি-ই লড়ছিল তার লিখালিখির মাধ্যমে সম্মিলিত নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে।
তার জের ধরে খ্যাতনামা বিভিন্ন স্কলার ও সচেতন মহলরা বলছেন, মূলত দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে অস্থির করে তুলতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থারা মিলে প্রতিনিয়ত নানা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ইসলামপন্থীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে দেখানোর অপচেষ্টা করা। নাস্তিকরা একটি ট্রাম্প কার্ড ব্যবহার করে, সেটি হল নবী-রাসুলদের নিয়ে কটুক্তি করা। এর মাধ্যমে তারা এদেশে নিজেদের অস্তিত্বের সংকট দেখিয়ে, বিভিন্ন দেশের আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে চেয়েছিল।
আর সুযোগটাকেই তারা ব্যবহার করেছে। এভাবেই বিগত ১৫ বছরে যাবত ইসলামবিদ্বেষী আওয়ামী সরকার ইসলাম পন্থীদের বিরুদ্ধে একচ্ছত্রভাবে পীড়ন নীতি চালিয়েছে। এভাবেই তারা এদেশের মানুষের কাছে ইসলামপন্থীদের “জঙ্গি”, “রাজাকার”, “যুদ্ধাপরাধী” ইত্যাদি ন্যারেটিভ তৈরি করে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল । এভাবে করেই এমন কিছু ঘটনা ঘটানো হয়েছে, যেখানে হেফাজত হত্যাকান্ড চালিয়ে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ,ইসলামি চিন্তক,যুবক ও আলেমকে হত্যা, গুম, খুন সহ বিভিন্ন নিরপরাধ মানুষদের ধরে ধরে দীর্ঘদিন কারাগারে রাখা হয়। ইসলামকে বাংলার বুক থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালানো হয়।
এভাবে আওয়ামী লীগ একটি অপশক্তির জোটে পরিণত হয়েছিল। যার ফলস্বরূপ, ফারাবীদের মতো অসংখ্য দেশপ্রেমীদের ফাঁসি, যাবজ্জীবন জেল, জুলুম কিংবা অনাচার করা হলেও, নিরাপদ আশ্রয়ে ঘোরাফেরা করত ধর্মবিদ্বেষী অপশক্তি ও নাস্তিক ব্লগাররা।
কেউ যদি অপশক্তির বিরুদ্ধে কথা বলতো, তবে প্রকাশ্যে দিনের আলোতে কিংবা রাতের গভীরে , যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল আবরার ফাহাদ কে সেভাবেই ধরে ধরে হত্যা করা হত এদেশের বিপ্লবী তরুণ-যুবকদের। ফারাবী তার লেখালেখির মাধ্যমে যেভাবে নাস্তিক ব্লগার, ধর্মবিদ্বেষী ও কট্টরহিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করতেন। এই কারণে তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। যার ফলে মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।কিন্তু সেদিন যদি এ দেশের জনগণ ফারাবীদের জন্যে আওয়াজ তুলত তবে হয়তু বুয়েটের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০১৯ সালে আবরার ফাহাদের মতো মেধাবী রত্নদের হারাতে হতো না এ বাংলার মানুষদের। সেই সুত্র ধরেই শুরু হয় আজকের ২৪ এর জুলাই গণ অভ্যুত্থান। আজকের এই অভ্যুত্থান এর জন্যে বছরের পর বছর লড়ে গিয়েছেন ফারাবীরা।
কিন্তু বছরের পর বছর হাসিনা রেজিমের বিরুদ্ধে লড়ে যাদের ত্যাগ তিতিক্ষায় ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যায় সেই হিন্দুস্থানে। সেই মহানায়ক ফারাবীরা এখনো জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পড়ে আছে।কিন্তু তাদের খুঁজ খবর নেওয়ার মতোও কেউ নেই এই জনপদে।সম্প্রতি সচেতন মহল থেকে আওয়াজ উঠতে থাকে মুক্তি চাই ফারাবীদের। ফারাবীদের মতো বছরের পর বছর ধরে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে একক লড়াই চালিয়ে যাওয়া কারাবন্দী বিপ্লবীদের। এমতাবস্থায় সরকারের নিরব ভূমিকায় প্রশ্ন উঠে এই সরকার কি মুক্তি দিবে শফিউর রহমান ফারাবির..?
এমনই বিভিন্ন মিথ্যা ও হয়রানি মূলক ভাবে মামলায় অপরাজনীতির শিকার হওয়া বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা প্রভাব, প্রতিপত্তি, অর্থ কিংবা ক্ষমতার জোরে একের পর এক মুক্তি পেলেও, মুক্তি মেলেনি আজও মেধাবী ছাত্র ফারাবীদের।
২০১৫ সালে লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যার সাথে ফারাবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলার পর, তৎকালীন প্রশাসন তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। তবে, যেদিন অভিজিৎ রায়কে বইমেলায় হত্যা করা হয়, সেদিন ফারাবি সিলেটে ছিলেন, এবং সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া অন্য আসামিরা কেউই ফারাবির সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেননি। অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় এই মামলায় নির্দোষ ফারাবীকে যুক্ত করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। সরকারপক্ষ, বিচারক, তদন্তকারী কর্মকর্তা কেউ এই হত্যার সাথে ফারাবির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে পারেনি। অথচ বিতর্কিত বিচারক মজিবুর রহমান (ওরফে বিচারক শেখ মুজিবুর রহমান) কুযুক্তি দেখিয়ে যাবজ্জীবন সাজা শুনিয়ে বিতর্কিত রায় দেন। ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এই বিতর্কিত রায় ঘোষণা করা হয়। পরে ২০২৩ সালের ৩০ শে জানুয়ারি ঢাকার সাইবার কোর্টে শেখ হাসিনাকে নিয়ে মন্তব্য করায় (৮৯/১৫) এই নাম্বারের ১টি মামলায় তার ৭ বছর কারাদন্ড হয় তথ্য প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারায়। এই সাজাটা বিচারক ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে দিয়েছিল। বিকাল ৩ টার দিকে কোর্ট থেকে সবাইকে বের করে দিয়েছিল। এই বিতর্কিত রায়ের ঘোষণা দিয়েছে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিতর্কিত বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াৎ ।
এছাড়াও, অভিজিৎ হত্যার ঘটনা, অন্য মামলায় এবং সিলেটের অনন্ত বিজয় হত্যাকাণ্ড মামলায় খালাস হয় ফারাবীর। এভাবে বেশ কিছু মিথ্যা মামলা ফাঁসিয়ে ১১ বছর কারারুদ্ধ করে রাখা হয় ফারাবীকে। লেখালেখি করার জন্য ৩৯ বছরের সাজা দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
১৯ শতকের শুরুর দিকের একটি ঘটনা,বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন এবং ১৯২৩ সালে একটি ব্রিটিশবিরোধী নিবন্ধ প্রকাশের কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কারাগারে বন্দী অবস্থায় কবি ৭ জানুয়ারি একটি জবানবন্দী লেখেন, যা পরে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে পরিচিতি পায়। এই প্রবন্ধে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বলেন, “আমি সত্যের পূজারী, আর সরকার ও তার কর্মচারীরা অসত্যের প্রতীক।” তিনি জানিয়ে দেন, তিনি আল্লাহর নির্দেশে ন্যায়কে ন্যায় এবং অন্যায়কে অন্যায় বলে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কবি বুঝতে পেরেছিলেন, পরাধীন ভারতবর্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললে তা ইংরেজদের কাছে রাজদ্রোহ হিসেবে গণ্য হতো। কিন্তু তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, “যে শাসন ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, তা কখনও চিরস্থায়ী হতে পারে না।”
ফারাবি ছিলেন বিদ্রোহী কবি নজরুলের মতোই দৃঢ়চেতার মানুষ। তার অবস্থানে ছিল অনড়। প্রথম দিকে তিনি কোনো আইনজীবী নিয়োগ না করে নিজেই আত্মপক্ষের সমর্থনে জবানবন্দী।পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন আইনজীবী তার মামলার দায়িত্ব নেন। নজরুল যেমন,সত্যে ও ন্যায়ের জন্য আপসহীনভাবে লড়ে গেছে, ঠিক ফারাবিরাও এই বঙ্গের সেই বিদ্রোহের একজন মূর্ত প্রতীক এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবিচল এক লৌহ মানব।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-