রাসেল চৌধুরী :
শুক্রবার বিকাল ৪ টা। আমার বাড়ী এবং আমার নির্বাচনী এলাকা উখিয়ার দিকে যাচ্ছিলাম। প্রাইভেট সিএনজির ড্রাইভার জানালো গাড়ীর বিয়ারিং নষ্ট হয়ে গেছে, পাল্টাতে হবে।
শুক্রবার হওয়ায় গাড়ীর প্রায় গ্রেজ বন্ধ। জেলগেটে একটি গ্রেজ খোলা ছিল। ড্রাইভার গাড়ীটি ওই গ্রেজে নিয়ে যায়। আমি অপেক্ষা করতে থাকি পাশের একটি চা দোকানে। ছোট টি স্টলে বসে মোবাইল ঘাটাঘাটি করছিলাম।
হঠাৎ দেখি, মুখে দাড়ি এবং চোখে পাওয়ারী চশমা পরা এক যুবক আমার দিকে তেড়ে আসলো এবং আমার সামনের টেবিলে থাকা একটি গ্লাস হাতে নিয়ে আমার দিকে গ্লাস উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে চেচিয়ে বলতে লাগলো, এই তুই দোসর সরকারের ভাইস চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী না? আমি প্রথমে ছেলেটির আকৃতি এবং গ্লাস নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসার ভঙ্গি দেখে মনে করেছিলাম ভবঘুরে পাগল! (পরে জানলাম, সে নাকি সমন্বয়ক, তার নাম আসি বাপ্পি) আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, কে আপনি? তার উত্তর পাওয়ার আগেই দেখি পুলিশের উপস্থিতি।
পুলিশ এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন আমার নাম কি। পেশা কি?
আমি আমার নাম, পেশা এবং ঠিকানা বললাম। তিনি দুই তিন হাত দুরে গিয়ে কার সাথে যেন কথা বললেন। এসে আমাকে বললেন, আমাকে থানায় যেতে হবে। আমি বললাম কেন? তিনি বললেন, ওসি স্যার আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমি আবারও বললাম, আমি কেন থানায় যাবো? আমার অপরাধ কি?
পরে আরও ৫/৭ জন যুবকের উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। তখন বুঝলাম সেই পুরনো কাহিনী, যা কিছু দিন ধরে চলছে। তখন পরিস্থিতি আচঁ করতে পেরে আমি পুলিশকে বললাম, চলেন। এই বলে গাড়ীতে উঠলাম। ওইসময় উপস্থিত যুবকদের একজন আরিয়ান ফারাবী পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলেন, উনাকে হাতকড়া পরান। পুলিশ বললো, উনি ভদ্রলোক, উনাকে হাতকড়া পরাতে হবে কেন? তখন তিনি পুলিশকে দমকের সুরে চোখ রাঙিয়ে কথা বলায় পুলিশ আমাকে হাতকড়া পড়াতে চাইলেন।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমি কেন হাতকড়া পড়বো, আমি চোর-ডাকাত নাকি? তখন পুলিশ তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বললেন, আমরা অসহায়, আমাদের করার কিছু নেই। তারা কথা বলতে বলতে আমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয় এবং থানায় নিয়ে আসে।
থানায় কেটে গেল নাটকীয় একটি রাত। আমি থানায় পৌছার আগেই দেখি, সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী, শুভার্থীদের ভীড়। সময় পেরোনোর সাথে সাথে সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভীড় আরও বাড়তে থাকে। এরিমধ্য উখিয়া থেকেও প্রচুর লোকজন এসে ভীড় করেন। অনেকে হাউমাউ করে কান্না করে আমাকে বুকে জড়িয়ে নেন। আমি অবস্থান করছিলাম ওসি তদন্তের রুমে। ওখানে ওসি সাহেব এসে আমার সাথে দেখা করেন। তিনিও জানালেন তার অসহায়ত্বের কথা।
তিনি বললেন, আপনাকে পুলিশ আটক করেনি, আটক করেছে সমন্বয়করা। সমন্বয়করা আপত্তি না করলে চলে যেতে পারবেন। ওসি সাহেবের এই কথা শুনে সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধুরা শুরু করলেন সমন্বয়ক ম্যানেজের চেষ্টা। তারা সফলও হলেন। নেতৃত্বস্থানীয় ২০/২২ জন সমন্বয়ককে নিয়ে আসলেন থানায়। তারা আমার সামনে পুলিশকে বললেন, উনার বিষয়ে আমাদের কোন অভিযোগ নেই, উনাকে ছেড়ে দিলে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায়। সমন্বয়কদের নাকি দুই তিনটি গ্রুপ। কোন এক গ্রুপ আপনার পক্ষে কথা বললে, অপর গ্রুপগুলো নাকি অটো আপনার বিপক্ষে হয়ে যায়! আমিও পড়লাম ওই গ্যাঁড়াকলে।
এরিমধ্য আমার অফিস আমার খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলো, পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কয়েক দফা ফোন আসলো। একদিকে আমার জন্য তদবির অপরদিকে সমন্বয়কদের একটি অংশের আপত্তি, এরমধ্যে দু-টানাই পড়ে পুলিশ সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে ৫৪ ধারায় কোর্টে পাঠাবেন। পরদিন ৫৪ ধারায় আমাকে কোর্টে পাঠানো হলো।
কিন্তু শনিবার বন্ধের দিন হওয়ায় শুনানি হলো না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে কারাগারে যেতে হলো। কারাগারে নির্ঘুম একটি রাত কাটালাম।
(কারাগারের একরাতের অভিজ্ঞতা আরেকদিন স্ব বিস্তারে তুলে ধরবো) ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, সকালে কারাগারে উখিয়ার সকল বন্দীদের সাথে আমার দেখা হলো, কথা হলো। বুকে বুক মেলানোর সুযোগ হলো। বাইরে থাকাবস্থায় জেলে বন্দী মানুষ গুলোর সাথে আমার দেখা করা যেখানে কোনভাবেই পসিবল ছিল না, সেখানে আমি জেলে যাওয়ায় সবার সাথে দেখাসাক্ষাৎ এর সেই সুযোগটি তৈরী হল । তারাও আমাকে কাছে পেয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত হলেন।
আমিও আমার উখিয়া-টেকনাফসহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের পরিচিত মানুষগুলোকে কাছে পেয়ে, সবার খোঁজখবর নিতে পেরে যারপরনাই তৃপ্ত হলাম। সকাল ৯ টার দিকে আমাকে আদালতে নিয়ে আসা হলো। আদালতে আমাকে দেখতে সকাল সাড়ে ৯ টা থেকে মামলা শুনানির আগ মুহুর্ত পর্যন্ত সহকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের কি যে অবস্থা, তা বর্ণনাতীত। দুপুর ২টার দিকে মামলার শুনানি শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে আমাকে এজলাসে নিয়ে যাওয়া হলো এবং বিজ্ঞ আদালত সব শুনে আমার জামিন মঞ্জুর করলেন।
এজলাসেও একটি ইন্টারেস্টিং বিষয় প্রত্যক্ষ করলাম, তা হলো, আমার মামলা ধরার সাথে সাথে এজলাসে উপস্থিত সকল এডভোকেট আমার পক্ষে দাড়িয়ে গেলেন। অথচ ওকালতনামায় আমার পক্ষে স্বাক্ষর করা উকিল ছিলেন মাত্র তিন জন।
শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যন্ত টানা ৪৬ ঘন্টা থানা, কোর্ট, জেল প্রাঙ্গণে শত শত নারী পুরুষ যেভাবে রাতদিন ঠাঁই দাড়িয়ে থেকে আমার জন্য দোয়া করেছেন, টেনশন করেছেন, কষ্ট করেছেন এবং কষ্ট সয়েছেন, আমি মনে করি, আমার এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে, এটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় অর্জন বা প্রাপ্তি।
“কারো না কারো প্রতিহিংসা চরিতার্থের শিকার হয়েও তাদের দিচ্ছি ধন্যবাদ। ৪৬টি ঘন্টায় অর্জন করলাম বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আর চিনতে পারলাম কে আপন কে পর!
৪৬টি ঘন্টা তাই আগামীর চলার পথের অমূল্য শিক্ষা হয়ে থাকবে।”
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-