বিশেষ প্রতিবেদক :
মিয়ানমারের টালমাটাল পরিস্থিতির জেরে বহু বছর ধরে বাংলাদেশের সীমান্ত জেলা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নিচ্ছেন রোহিঙ্গারা।
তাদের জন্য তহবিল বাড়াতে আইওএমের (আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা) কাছে একাধিকবার আবেদন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেশ কিছু উদ্যোগও নিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। নেতৃত্বে রয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রত্যাবাসনের কথা থাকলেও সেটিতো হয়-ই-নি; বরং নতুন করে আরো রোহিঙ্গা ঢুকছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে থাকা লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভবিষ্যৎ কী হবে?
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ, রোহিঙ্গাদের দ্রুত স্বদেশে প্রত্যাবাসনসহ ৭ দফা দাবিতে গতকাল শুক্রবার কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালীতে মানববন্ধন করেছে অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি নামে একটি সংগঠন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে গত সাত বছর ধরে বহু চেষ্টা এবং আলোচনা হলেও কার্যত একজনকেও প্রত্যাবাসন করা যায়নি। তার ওপর মিয়ানমারে এই মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে এই প্রত্যাবাসন এখন আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায় স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের ফেরাতে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে করা মামলায় দ্রুত একটি ইতিবাচক ফলাফলের দিকে তাকিয়ে আছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কবে সেই ইতিবাচক ফলাফল আসবে তাও বলা মুশকিল।
প্রশ্ন উঠেছে সাত বছর পরও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া আর কতদূর? তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক যে অর্থ সহায়তা পাওয়া যায়, তা কমে আসা নিয়ে সরকারের উদ্যোগই বা কী?
প্রসঙ্গত, গত বছরের আগস্টে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আলোচনায় উঠে আসে রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গও।
ওই বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার সময় এই শরণার্থীদের নিয়ে ঢাকার অবস্থান যা ছিল, এখনো তাই রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের সহায়তা করবে সরকার। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।
এরকম পরিস্থিতির মধ্যে রাখাইন প্রদেশ দখলে নেয় আরাকান আর্মি। আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পর্ক ভালো নয়। আরাকান আর্মি রাখাইন দখলে নেয়ার পর সেখান থেকে দফায় দফায় অন্তত ৬০ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে ঢুকেছে। আরো ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন দূরে থাক; নতুন করে আরো লাখ চারেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে। এরা বাংলাদেশে ঢুকে গেলে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শূন্য হবে।
সবমিলিয়ে ভূ-রাজনীতির কৌশলে বাংলাদেশের ওপরে এসে রোহিঙ্গারা ভর করছে। এ অবস্থায় প্রত্যাবাসন তো দূরের কথা, তাদের ভরণপোষণ নিয়েই সরকারকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত আট বছর ধরে রোহিঙ্গারা এক মানবেতর জীবনযাপন করছে। একদিকে তারা নিজ দেশে পরবাসী, অন্যদিকে বিশ্ব মোড়লরা তাদের নিয়ে খেলা করছে। বাংলাদেশ সরকার বলছে, এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে দেখ ভাল করার সামর্থের অভাব রয়েছে। সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার জন্য বলছে। সরকারের আহ্বানে বেশ কিছু দেশ সাহায্যের প্রতিশ্রæতি দিলেও এর পরিমাণ কমে আসছে। জাতিসংঘ থেকেও পর্যাপ্ত তহবিল পাওয়া যাচ্ছে না।
সবমিলিয়ে ভারত, চীন, রাশিয়া মুখে বললেও এরা এখনো সমস্যা সমাধানে আগ্রহী নয়। উপরন্তু, মিয়ানমারকে তারা বিভিন্নভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ এখনো নিজেকে বিবৃতি দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষণে রয়েছে। এ অবস্থায়, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত কী- তা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে।
এরকম পরিস্থিতি সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, এই মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় শত ভাগ আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে; এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে এখনই কথা বলা যাচ্ছে না। তাই আগামী দুই থেকে ছয় মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা নেই। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে সেখানেও শান্তি থাকবে না।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যবাসন কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায় বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ কী করবে? যদি বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা স্থায়ীভাবেই বাস করতে থাকেন, তাহলে তাদের ভূমিকা কী হবে? পাশাপাশি এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী করবে? কারণ দিনে দিনে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগও কমে আসছে।
জানতে চাইলে কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সাবেক চেয়ারম্যান মুন্সি ফয়েজ আহমদ বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং আরাকান আর্মির সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে হবে।
তার মতে, প্রত্যাবাসন আর কখনোই হবে না- এমনটি ভাবা ঠিক নয়। কারণ তাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতেই হবে। তবে এটা ঠিক, পরিস্থিতির কারণে এখনই হয়তো প্রত্যাবাসন হবে না। আবার কখন হবে এটাও বলা মুশকিল। কিন্তু প্রত্যাবাসনের আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।
এদিকে, সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পঠিত মূল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে শুরুতে যেভাবে আলোচনা হত এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশে এখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় দশ লাখ। বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশ তাদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টায় মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।
তবে বাংলাদেশ সরকার বলছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ কূটনৈতিক ও আইনি দুই প্রক্রিয়াতেই এগোচ্ছে। ২০২৩ সালে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ে। যা এখনো চলমান। সরকার এখন আন্তর্জাতিক আদালতের দিকে তাকিয়ে আছে। গাম্বিয়ার মাধ্যমে সেখানে মামলাটি করা হয়। তবে এটা ঠিক, আন্তর্জাতিক আদালত থেকে এখন পর্যন্ত যে ফলাফল এসেছে তা খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষক মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতে এই মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে নজর রাখতে হবে। এছাড়া প্রত্যাবাসনে ভারত ও চীনের ভূমিকা অত্যন্ত বেশি। তাদের আরো বেশি করে যুক্ত করতে পারলে বিশ্বাস করি- এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তবে সেটি হতে হবে যথাযথ ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন। আন্তর্জাতিক চাপ যদি চলমান থাকে এবং আন্তর্জাতিক আদালতের রায় যদি পক্ষে থাকে; তখন মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন শুরু করতে পারা যাবে বলেও তিনি জানান।
তবে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেছেন, মিয়ানমারে প্রতিদিনই কোনো না কোনো শহর বিদ্রোহীরা দখল করছে। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে। ফলে এমন পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। এছাড়া ২০২৩ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের অর্থায়ন একেবারেই কমে গিয়েছিল। আগে একজন রোহিঙ্গার জন্য মাথাপিছু ১২ ডলার বরাদ্দ ছিল। কিন্তু তা কমে একেবারে আট ডলারে নেমে গিয়েছিল। তবে গত বছর থেকে আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। এটি এখন দশ ডলারের বেশি। যত দিন যাচ্ছে ততই অর্থায়ন কমছে। কিন্তু অর্থায়ন জরুরি। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারকেই রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়।
উল্লেখ্য, সর্বপ্রথম ১৯৭৮ সালে দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ-মায়ানমারের সীমান্ত জেলা কক্সবাজারে আসে। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের শিকার হয়ে কক্সবাজারে আসে আরো ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। এরপর ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত হামলা গণহত্যা চালানোর পর কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আসে আরো সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। এদের সাথে আগে থাকা উল্লিখিতরা মিলে কক্সবাজার জেলা এখন ১৫ লাখ রেহিঙ্গা শরণার্থীর আবাসভূমি। এদের ছয় লাখ এখন আছে শরণার্থীদের জন্য নির্মিত কুতুপালং মেগা শিবিরে। আর এটি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা শিবির।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-