আবদুর রহমান, টেকনাফ :
পাহাড়, সমুদ্রঘেরা সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে একের পর এক অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় আতঙ্ক এবং ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয়দের মধ্যে। এ উপজেলার জনসংখ্যা সাড়ে ৩ লাখ। পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে এ উপজেলা গুরুত্বপূর্ণ।
তবে ২০১৭ সালে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে টেকনাফে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে স্থানীয়রা এমনিতেই নানা সংকটে পড়েছেন। তার ওপর এখন যুক্ত হয়েছে অপহরণ আতঙ্ক।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র বলছে, গত এক বছরে টেকনাফে অন্তত ১৮৭ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯১ জন স্থানীয় ও বাকিরা রোহিঙ্গা। এর মধ্যে অন্তত দেড়শ জনকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেতে হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর দুই দিনে টেকনাফে ২৭ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। গত সোমবার রাতে টেকনাফের বাহারছড়ায় মুদির দোকানি জসিম উদ্দিনকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায় মুখোশধারীরা। ওইদিন সকালেই হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুড়া এলাকায় বনে কাজ করতে যাওয়া রোহিঙ্গাসহ ১৯ জন শ্রমিক অপহরণের শিকার হন। তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে অপহরণকারীরা জনপ্রতি এক লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করে। তবে গতকাল এ অপহৃতদের মধ্যে ১৮ শ্রমিককে উদ্ধার করেছে র্যাব ও পুলিশ। গতকাল বিকেলে হ্নীলা ইউনিয়নের লেদার রংগীখালী পশ্চিমের দুর্গম পাহাড় থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়।
দীর্ঘ অভিযানে বনে অপহৃতদের উদ্ধার করা হয়েছে উল্লেখ করে কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের প্রচেষ্টা ছিল অপহৃতদের জীবিত উদ্ধার করার। মূলত ড্রোন অভিযানের ফলে অপহরণকারীরা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে যায়। এর কারণে আমরা অপহৃতদের উদ্ধারে সক্ষম হয়েছি। বাকি অপহৃতদেরও উদ্ধারের অভিযান চলছে।’
এদিকে মঙ্গলবার সকালে হোয়াইক্যং-শামলাপুর সড়কে দুটি অটোরিকশা থামিয়ে চালকসহ আরও ৮ জনকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে মুখোশধারীরা। খবর পেয়ে বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তবে অপহৃতদের নাম-ঠিকানা জানা যায়নি। বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক শোভন কুমার সাহা জানান, অটোরিকশা থেকে চালকসহ যাত্রী অপহরণের ঘটনা শুনে অভিযান চালানো হচ্ছে। কতজন অপহৃত হয়েছেন সেটির সঠিক তথ্য এখনও জানা যায়নি। অটোরিকশা দুটি উদ্ধার করা হয়েছে।
জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, বিশেষ করে উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়ায় অপহরণের ঘটনা বেশি ঘটছে। সবচেয়ে বেশি বাহারছড়ার নোয়াখালীপাড়া, বড় ডেইল, মাথাভাঙা, জাহাজপুড়া, ভাগগুনা, মারিশবনিয়া, হোয়াই্যকংয়ের ঢালা, চৌকিদারপাড়া, দক্ষিণ শীলখালী গ্রামের মানুষ বেশি অপহরণ ভয়ের মধ্য আছেন। মূলত পাহাড়ি এলাকাগুলোয় বেশ কয়েকটি অপহরণ চক্র সক্রিয়। স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তির ছত্রছায়ায় তারা বিভিন্ন অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে।
গত সোমবার রাতে বাহারছড়া থেকে অপহৃত মুদি দোকানি জসিম উদ্দিনের ভাই জালাল উদ্দিন বলেন, ‘তিন বছর আগেও আমার আরেক স্বজনকে ধরে নিয়ে যায়। সে সময় হত্যার হুমকির দিয়ে ১৬ লাখ টাকার মুক্তিপণ দাবি করেছিল অপহরণকারীরা। ১৬ লাখ টাকা দিয়ে ওই আত্মীয়কে ফিরে আসতে হয়েছে।’
বাহারছড়ার এক জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘মূলত পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে টেকনাফে এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে। গত দুই মাসে আমার এলাকায় ৩০ জনের বেশি অপহরণের শিকার হয়েছেন। সবাই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন।’
বাহারছড়ার ইউপি সদস্য হুমায়ুন কবির বলেন, ‘যতক্ষণ স্থানীয় মানুষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জনপ্রতিনিধিরা যৌথভাবে কাজ না করবেন, ততদিন এ অপরাধ রোধ অসম্ভব।’
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঝিমিয়ে পড়ার বিষয়টি অস্বীকার করে অপহৃতদের উদ্ধারে অভিযান চলছে বলে জানান টেকনাফ মডেল থানার ওসি গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমরা গত জানুয়ারি থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩৮ জন অপহৃতকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। ২০টি মামলায় বেশ কয়েকজন অপরাধীকে আটক করা হয়েছে।’
টেকনাফের ইউএনও শেখ এহেসান উদ্দীন বলেন, ‘পাহাড়ে স্থানীয়দের সহায়তায় অপহৃতদের উদ্ধারে র্যাব ড্রোন অভিযান চালাচ্ছে। আশা করছি, তাদের দ্রুত উদ্ধার করতে সক্ষম হব। পাশাপাশি অপহরণ-মুক্তিপণ বন্ধে কর্তৃপক্ষকে যৌথ অভিযান চালানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-