রাখাইনে বেড়েছে বাংলাদেশি পণ্যের পাচার: আসছে বিপুল মাদক!

তোফায়েল আহমদ, কালেরকন্ঠ:

মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের (আরাকান) বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ এখন বাংলাদেশি নিত্যপণ্যের ওপর নির্ভর করছে। আরাকানের বন্দর শহর মংডু জান্তা সরকারের হাতছাড়া হওয়ার পর মায়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন এবং জেলা শহর আকিয়াবের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর পর থেকে সেখানে নিত্যপণ্যের তীব্র সংকট চলছে। এর জেরে রাখাইনে বাংলাদেশি পণ্য পাচার বেড়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পাচারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশি পণ্যের বিনিময়ে ইয়াবা, আইসসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য আসছে।

রাজ্যটির পশ্চিমাঞ্চলীয় (নাফ নদের পূর্বে) বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশি মোবাইল নেটওয়ার্ক। সেখানে কেনাকাটাও চলছে বাংলাদেশি টাকায়। নাফ নদের এপার-ওপার মোবাইল অ্যাপ বিকাশে লেনদেন চলছে।

এ কারণে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে নিত্যপণ্য পাচার বেড়ে গেছে। বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার পাঁচটি উপজেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে দেদার পাচার হচ্ছে বাংলাদেশি পণ্য। এমনকি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকার নৌপথেও পণ্য পাচার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মায়ানমারের বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি বন্দর শহর মংডু দখলে নেওয়ার পর ক্ষুুব্ধ জান্তা সরকার রাখাইনে সে দেশের পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে আরাকানে নিত্যপণ্যের সংকট বাড়ছে।

সীমান্তের এপারের লোকজন জানিয়েছে, ওপারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দামও বেড়েছে। অতি মুনাফার লোভে অসাধু লোকজন পণ্য পাচারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ওষুধ থেকে শুরু করে পানীয় জলের বোতল পর্যন্ত যাচ্ছে।

নাফ নদের ওপারে আরাকানের মংডু এলাকায় বাংলাদেশি মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকায় সেখানকার খবরাখবরও প্রতিনিয়ত পাওয়া যাচ্ছে।

গতকাল শুক্রবার সকালে মংডু এলাকা থেকে পাওয়া কয়েকটি গ্রামীণ দোকানের চিত্রে বাংলাদেশি পণ্য বিক্রি হতে দেখা যায়। মংডু শহরের উত্তরে অন্তত ১০ কিলোমিটার এবং টেকনাফের হ্নীলা দমদমিয়া এলাকার নাফ নদের চার কিলোমিটার পূর্বের বুড়া সিকদার পাড়ার একজন বাসিন্দা জানান, আরাকানের খাল-বিলে জাল ফেললেই মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু রান্নার উপকরণের তীব্র অভাব। এক বোতল পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের দাম বাংলাদেশি টাকায় আড়াই হাজার টাকা। যে পেঁয়াজ-রসুন একসময় মংডু থেকে হরদম টেকনাফে আসত, এসব এখন খুব দামি পণ্য ওপারে। মংডু এলাকায় বাংলাদেশি নগদ টাকায় কেনাবেচাসহ বিকাশে লেনদেন এখন সবচেয়ে সহজ হয়ে উঠেছে।

কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উখিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সরওয়ার জাহান চৌধুরী এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে পণ্য পাচারের ক্ষেত্রে আমাদের মূল সমস্যাটা হচ্ছে মাদকদ্রব্য। বাংলাদেশি নিত্যপণ্যের বিনিময়ে মায়ানমার থেকে আমাদের প্রাপ্তি কেবল ইয়াবা-আইসসহ নানা নামের মাদক। এ জন্যই আমাদের মাথাব্যথা বেশি।’

আরাকানের বিশাল এলাকা যেহেতু বাংলাদেশি মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল, এপার থেকে মোবাইল ফোন সামগ্রীও ব্যাপক পাচার হচ্ছে। ওপারে মোবাইলও ব্যবহৃত হয়ে থাকে বাংলাদেশি সিম নিয়ে। আরাকান আর্মির মংডু দখলের পর থেকে পুরো আরাকানে মায়ানমারের মোবাইল নেটওয়ার্কসহ বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। সৌর বিদ্যুতে চলছে মোবাইল ফোন রিচার্জ।

রাখাইন রাজ্যের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের কক্সবাজার রিজিয়নের রামু সেক্টরের অধীন টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়ানের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর সৈয়দ ইশতিয়াক মুর্শেদ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত এলাকায় নাফ নদে টহল জোরদার করা হয়েছে। সীমান্তের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে।

গতকাল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের একজন বাসিন্দা বলেন, ‘একটি পরিবারে জীবন ধারণে যা যা প্রয়োজন, সবই এখন পাচার হচ্ছে এপার থেকে। এমনকি এ দেশের মিনারেল ওয়াটারের চাহিদাও ব্যাপক সেখানে। আমাদের বাজারের চা দোকানের রুটি-পরোটা পর্যন্ত ওপারে চলে যাচ্ছে।’

কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি ও সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফ সংসদীয় আসনের সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী মায়ানমারে নিত্যপণ্য পাচারের বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেন, ‘সীমান্তে বালুখালী-তুমব্রু এলাকা থেকে টেকনাফের জাদিমুরা পর্যন্ত অন্তত দুটি পয়েন্ট দিয়ে নিত্যপণ্য পাচার হচ্ছে মায়ানমারে। এভাবে নিত্যপণ্য পাচার অব্যাহত থাকলে আমাদের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।’

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘আমার এলাকা দিয়ে কয়েক দিন ধরে সবচেয়ে বেশি পণ্য পাচার হচ্ছে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে তুমব্রু, নয়াপাড়া জিরো পয়েন্ট ও ঘুমধুম এলাকা দিয়ে প্রচুর পরিমাণ পণ্য পাচার হচ্ছে। রাতের আঁধারে ওপার থেকে রোহিঙ্গাদেরও অনুপ্রবেশ ঘটছে। স্থানীয় অসাধু লোকজন টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় সূত্র মতে, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে সিমেন্ট, ইউরিয়া সার, ভোজ্য তেল, চাল-ডাল, তরিতরকারি, কাপড়-চোপড়সহ অন্যান্য সামগ্রী। গত ৯ ডিসেম্বর রাতে মায়ানমার পাচারকালে কক্সবাজারের চকরিয়ায় ৪০ বস্তা সার উদ্ধার করেছে পুলিশ। চকরিয়া থেকে এই সার মহেশখালী উপকূল দিয়ে নৌপথে মায়ানমারে পাচারের চেষ্টা করা হয়।

চকরিয়া থানার ওসি মনজুর কাদের ভুঁইয়া জানান, জব্দ করা সারের তালিকা তৈরি করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। অপরদিকে মায়ানমারে পাচারকালে ৩৫০ বস্তা সিমেন্টবোঝাই একটি বোট মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকার সাগরে ডুবে গেছে। গত ১০ ডিসেম্বর সিমেন্টবোঝাই বোটের ছয়জন পাচারকারীকে উদ্ধার করা হয়।

কুতুবদিয়া থানার ওসি আরমান হোসেন জানান, উদ্ধার করা ছয় পাচারকারীর মধ্যে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের তিনজন রোহিঙ্গাও রয়েছেন। ডুবে যাওয়া বোট থেকে উদ্ধার করা ছয়জন পুলিশের কাছে পাচারের কথা স্বীকার করেছেন।

আরও খবর