সিলেট প্রতিনিধি :
সিলেটের কানাইঘাট থেকে নিখোঁজ হওয়া শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনকে (৫) অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষক শামীমা বেগম মর্জিনার পরিকল্পনায় অপহরণের পর বস্তাচাপা দিয়ে শিশুটিকে হত্যা করা হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন শামীমা।
এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হলেন মুনতাহার প্রতিবেশী কানাইঘাট সদরের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীমা বেগম মর্জিনা, তার মা আলিফজান বেগম, প্রতিবেশী নাজমা বেগম ও ইসলাম উদ্দিন। মর্জিনার নানিসহ আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেওয়া হয়েছে। তবে তাদের নাম-পরিচয় জানায়নি পুলিশ। নিহত মুনতাহা কানাইঘাট সদরের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মুনতাহার পরিবারের সঙ্গে কারও বিরোধ ছিল না। কয়েক মাস আগে গৃহশিক্ষক হিসেবে মুনতাহাকে পড়াতেন প্রতিবেশী শামীমা। তার চলাফেরা ভালো মনে না হওয়ায় মুনতাহাকে আর পড়াতে হবে না বলে শামীমাকে নিষেধ করেন শিশুটির বাবা শামীম। সেই থেকে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। পরিকল্পনা করেন হত্যার। ৩ নভেম্বর সকালে বাবার সঙ্গে স্থানীয় একটি মাহফিল থেকে বাড়ি ফিরে প্রতিবেশী শিশুদের সঙ্গে খেলতে গিয়েছিল মুনতাহা। বিকাল হলেও বাড়িতে না ফেরায় খোঁজ নিতে গিয়ে আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। নিখোঁজের পর থেকে পরিবার দাবি করে আসছিল, পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, মুনতাহার বাবা শামীম আহমদ শনিবার কানাইঘাট থানায় অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অপহরণ মামলা করেন। মামলার পর শনিবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুনতাহার প্রতিবেশী শামীমা বেগমকে থানায় আনে পুলিশ। মুনতাহাকে প্রাইভেট পড়াতেন শামীমা। সম্প্রতি শামীমার কাছে মেয়েকে পড়াতে পাঠাননি। শামীমাকে আটকের পরই নিখোঁজের ঘটনার মোড় ঘুরে যায়। শনিবার রাতে শামীমার মা ডোবা থেকে লাশ নিয়ে পুকুরে ফেলতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েন। হত্যায় সহযোগিতা করেন আলিফজান, নানি কুতুবজান, প্রতিবেশী নাজমা বেগম ও ইসলাম উদ্দিনসহ আরও কয়েকজন।
থানায় জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে হত্যায় সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন শামীমা। তিনি জানান, ৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় তাদের ঘরে মুনতাহাকে গলা টিপে ও বস্তাচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। লাশ গুমের জন্য ডোবায় রাখা হয়েছিল। পরে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে ডোবা থেকে লাশ তুলে পুকুরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
রবিবার বিকালে মুনতাহার বাড়িতে যান সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। এ সময় তিনি বলেন, ‘মুনতাহা হত্যার ঘটনায় পুলিশ ইতোমধ্যে তিন নারী ও একজন পুরুষকে গ্রেফতার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এর মধ্যে শামীমা হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। প্রাইভেট না পড়ানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আরও অন্য কারণও থাকতে পারে, সেটি আমরা তদন্ত করে দেখছি। হত্যাকাণ্ডে আরও কারও সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা, তদন্তে তা বের হয়ে আসবে।’
মুনতাহার স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, শনিবার রাতে শামীমাকে থানায় নেয় পুলিশ। এ সময় আচরণ সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তার বাড়িতে তল্লাশি চালায় স্থানীয়রা। সেইসঙ্গে কয়েকজনকে পাহারায় বসানো হয়। রাত সাড়ে ৩টার দিকে আলিফজানকে পুকুর পাড় দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেন স্বজনরা। এ সময় তাকে আটকাতে চাইলে পালানোর চেষ্টা করেন। পরে ওই পুকুরের পাড়ে মুনতাহার লাশ দেখতে পান তারা।
পুলিশ জানায়, লাশ উদ্ধারের সময় মুনতাহার শরীরে কাদামাটি লেগে ছিল। গলায় রশিজাতীয় কিছু পেঁচানো ছিল। এতে ধারণা করা হচ্ছে, শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। রবিবার দুপুরে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
মুনতাহার বাবা শামীম আহমদ বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন তছনছ করে দিয়েছে শামীমা ও তার পরিবার। তাদের পরিবার দরিদ্র হওয়ায় প্রায় সময় খাবার ও নানাভাবে সহযোগিতা করতাম। শামীমার চলাফেরা খারাপ হওয়ায় মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতে নিষেধ করেছিলাম। কারণ মুনতাহাকে নিয়ে সে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যেতো। এজন্য বলেছিলাম, মেয়েকে আর পড়ানোর দরকার নেই। কিন্তু সেই ক্ষোভে আমার মেয়েকে হত্যা করবে শামীমা, তা কল্পনাও করতে পারিনি।’
মুনতাহার চাচা কয়ছর আহমদ বলেন, ‘যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা সবাই আমাদের প্রতিবেশী। মুনতাহার বাবা আগে সৌদিপ্রবাসী ছিলেন। কয়েক বছর আগে দেশে ফিরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালান। তার পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে। মুনতাহা পঞ্চম। কারও সঙ্গে আমার ভাইয়ের বিরোধ নেই। তবে শামীমার কাছে প্রাইভেট পড়াতে না দেওয়ার ক্ষোভ থেকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। অন্য কোনও বিরোধ নেই।’
সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘৩ নভেম্বর মুনতাহার বাবা মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছেন না মর্মে থানায় জিডি করেন। পরবর্তীতে মামলার এজাহার দায়ের করলে তদন্তে নামে পুলিশ। তদন্তের সূত্র ধরে শামীমাকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কথা স্বীকার করে শামীমা বলেছেন, ওই দিন সন্ধ্যায় তাদের ঘরে মুনতাহাকে গলা টিপে ও বস্তাচাপা দিয়ে হত্যা করেছেন। এ ঘটনায় আরও কয়েকজনের নাম এসেছে। আমরা তাদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছি।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-