তিস্তা থেকে মহারশি: দুর্ভোগ ও মৃত্যুর দায় কার?

 

মোহন কুমার দাশ

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে এ বছরের আগস্টে ঘটে যাওয়া অভূতপূর্ব বন্যার ক্ষত না শুকাতেই সেপ্টেম্বরের শেষদিকে ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারসহ সংশ্লিষ্ট নদনদীর পানি বেড়ে উত্তরাঞ্চলের বড় অংশকে ডুবিয়ে দেয়। এর কয়েক দিনের মধ্যে অতিভারী বৃষ্টি ও গারো পাহাড়ের ঢলের কারণে এবং মহারশি নদীর বাঁধ ভেঙে শেরপুর-ময়মনসিংহ-নেত্রকোনায় স্মরণাতীতকালের প্রলয়ংকরী বন্যা হয়।

এবারের বন্যায় নদীভাঙন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষি, গবাদি পশু এবং মৎস্য সম্পদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা অপূরণীয়। ভুক্তভোগী মানুষ এ বন্যাকে ১৯৮৮ সালের বন্যার চেয়েও ভয়াবহ বলছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন অন্তত ৯ জন।

সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে আগস্ট ২০২৪-এর বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ১৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জরুরি শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্যমতে, এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫৬ লাখ মানুষের মধ্যে ২০ লাখেরও বেশি শিশু শারীরিক, মানসিক ও নানা ঝুঁকিতে আছে। কিন্তু পূর্বাঞ্চলের বন্যা থেকে আমরা কোনো শিক্ষা নিলাম না। তাই পূর্বাভাস ও প্রস্তুতির অভাবে বন্যায় উত্তরাঞ্চল ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রান্তিক মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ হলো।
তিস্তা একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। উত্তরাঞ্চলের বন্যায় এ নদীর ভূমিকা অনেক। পত্রিকার রিপোর্টে জেনেছি, এ বছরের ৪ অক্টোবর এক দিনে উজানের পানি এসেছে প্রায় ৮৭ হাজার কিউসেক। বছরে দুই কোটি টনেরও বেশি পলি এসে জমে তিস্তা নদীতে। ফলে নদীর পানি নির্দিষ্ট বিপৎসীমা অতিক্রমের আগেই বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। এখন বন্যার বিপৎসীমাও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল।

শুষ্ক মৌসুমে পানির ন্যায্যতা, বর্ষা মৌসুমে ব্যারাজ খোলা রাখা, উজানের বৃষ্টির পরিমাণ, নদনদীর পানি সমতল, ডিসচার্জ ও ড্যামের পানি ছাড়ার আগাম সতর্কতা দুই দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যৌথ নদী কমিশনের ভূমিকা জনবান্ধব নয়। এমনকি মহারশি যৌথ নদী কমিশনের ৫৪টি নদীর তালিকায় অনুপস্থিত।

এ বছর বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। বন্যার সংখ্যাও বেশি ছিল। নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চলের বন্যার অন্যতম কারণ সক্রিয় মৌসুমি নিম্নচাপের ফলে লাগাতার অতি তীব্র ভারী বৃষ্টি। এই বৃষ্টি বায়ুমণ্ডলীয় নদী (অ্যাটমোস্ফিয়ারিক রিভার) বা মেঘ বিস্ফোরণের (ক্লাউড বার্স্ট) কারণে কিনা, সেটা গবেষণা করা প্রয়োজন। অতি তীব্র ভারী বৃষ্টির সঙ্গে ছিল সীমান্ত-সংলগ্ন উজান থেকে আসা ঢল। রাজনৈতিক ও পেশিশক্তির দাপটে দখল-দূষণের কবলে বাংলাদেশের নদী, খালবিল, নালা-নর্দমা। অপরিকল্পিত উন্নয়নে পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক চ্যানেলগুলো প্রায় অবরুদ্ধ। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিপর্যয়কর বন্যার কবলে শহর, গ্রাম সব অঞ্চল।

রংপুর-শেরপুর-ময়মনসিংহ-নেত্রকোনার বন্যা এমন সময় ঘটছে যখন বর্ষা শেষের দিকে। সাধারণত বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে বর্ষাকালের সমাপ্তি। আমাদের দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণগত শ্রেণিবিন্যাসও যুগোপযোগী ও জনবান্ধব নয়। এখানে ২৪ ঘণ্টায় ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিকে ভারী এবং ৮৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিকে অতি ভারী বলা হয়। এই শ্রেণীকরণ তথা হালকা, মাঝারি, ভারী শব্দগুলো দিয়ে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষ কীভাবে কী প্রস্তুতি নেবে, সেটা অস্পষ্ট। পরপর দুটি বন্যার রেকর্ড থেকে জানা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিদিন ২০০-৩০০-৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টির ঘটনা ঘটছে, যা ভারী, অতি ভারীর সীমানা ছাড়িয়ে অনেক অনেক বেশি।

বন্যায় প্রস্তুতিহীন অবস্থায় উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে নেই খাবার, ওষুধ, স্যানিটেশন, নিরাপত্তা। নৌযান না থাকায় অনেকে ইচ্ছা করলেও যেতে পারছে না আশ্রয়কেন্দ্রে। এ অবস্থায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। কত লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় ঝুঁকিতে রয়েছে, সেটা এখনও সঠিক নিরূপিত হয়নি। আসলে দুর্যোগের এ দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিজেও দুর্যোগে আক্রান্ত।

দুর্যোগের পূর্বাভাস, সতর্কতা ও ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান বাধা চিহ্নিত করতে হবে। প্রফেশনালদের সক্ষমতা বাড়াতে ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) মাধ্যমে ‘ইন্টিগ্রেটেড ট্রেনিং কোর্স অন নিউম্যারিক্যাল মডেলিং, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড জিও-স্পেশাল টেকনোলজি ফর আর্থ অ্যান্ড ওশান সায়েন্স রিসার্চ’ সংশ্লিষ্ট সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা উচিত। বৃষ্টি ও বন্যার পূর্বাভাসের গাণিতিক মডেলের গ্রহণযোগ্য মাত্রায় উন্নয়নে বাংলাদেশে আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষণায় সুপার কম্পিউটারে সিমুলেশন প্রয়োজন।

গাণিতিক মডেলে বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তরের (এসওবি) মাধ্যমে খুব উচ্চ রেজল্যুশনের টপোগ্রাফিক ডেটা ব্যবহার করতে পারলে পূর্বাভাসের মান উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এক্সপেরিমেন্ট করা প্রয়োজন।

ভবিষ্যতে দেশের কোনো অঞ্চল যাতে অবহেলার শিকার না হয়, এ জন্য কতিপয় প্রয়োজনীয় সুপারিশ উপস্থাপন করা হলো–

১. বৃষ্টি ও বন্যার পূর্বাভাসের জন্য উন্নত প্রযুক্তি, ডেটা বিশ্লেষণ ও গাণিতিক মডেল ব্যবহার করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও গবেষণার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। মোবাইল অ্যাপ, ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহজবোধ্য ভাষায় গ্রহণযোগ্য সতর্কতা সংকেত প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে।

২. স্থানীয় জনগণকে বন্যা মোকাবিলায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপ গঠন করে তাদের জরুরি পরিস্থিতিতে উদ্ধারকাজ পরিচালনা ও ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় কাজে লাগাতে হবে।

৩. বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকা দরকার। পাশাপাশি জনগণকে সম্পৃক্ত করে উন্নত বন্যা প্রতিরোধক বাঁধ, সড়ক ও জলাবদ্ধতা নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে।

৪. নদী ও জলাশয়ের দখল-দূষণ প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে; আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেন রক্ষকের বদলে ভক্ষক না হয়।

৫. বর্ষা মৌসুমের বন্যাসহ সব দুর্যোগ ও দূষণ মোকাবিলায় প্রস্তুতি এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট যোগ্য বিশেষজ্ঞদের দিয়ে একটি সময়োপযোগী জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। দুর্যোগের রিয়েল টাইম ইভেন্ট নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য বাজেট বরাদ্দ থাকা উচিত।

৬. আঞ্চলিক সহযোগিতা ও ডেটা শেয়ারিংয়ের জন্য কূটনৈতিক সক্ষমতার উন্নতি ঘটাতে হবে। সার্ক, বিমসটেকের কার্যকারিতা বাড়িয়ে গবেষণা কার্যক্রমে বিনিয়োগ করতে হবে। বেসরকারি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

৭. বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল সংস্কার প্রয়োজন। এসব প্রতিষ্ঠানে বিসিএস পরিত্যক্তদের নন-ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেশের সেরা মেধাবীদের জায়গা দিতে হবে। বিজ্ঞানীদের ক্যাডার সার্ভিসের চেয়েও উচ্চ মর্যাদা দিয়ে নিয়োগবিধি সংশোধন করা সময়ের দাবি। দুর্যোগ ও দূষণের এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

  • ড. মোহন কুমার দাশ (লেখক)
  • নির্বাহী পরিচালক, ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউট (নোয়ামি)
  • যুগ্ম সম্পাদক, সাউথ এশিয়ান মিটিওরোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (সামা)
  • ইমেইল: smrc@gmail.com