রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে দালাল ‘সেই মানব ও ইয়াবা পাচারকারীরা’

নুপা আলম :

ক্যাম্পে নুতন এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের একটি পরিবার। ছবি : সুজাউদ্দিন রুবেল।
  • নাফনদী ও সাগর উপকুলের অর্ধশত ঘাটে তৎপর কয়েক শত নিজস্ব পাহারাদার

সীমান্তবর্তী কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার পূর্বে নাফনদীর ওপারেই মিয়ানমার। আর দক্ষিণের অংশ হয়ে পশ্চিমে এই উপজেলায় রয়েছে বঙ্গোপসাগরের অন্তত ৫০ কিলোমিটার সৈকত। বঙ্গোপসাগর বা নাফনদীর এই এলাকার কিছু দূর পর পর এক-একটি ঘাট। আর সেই প্রতিটি ঘাট যেন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের জন্যই ব্যবহার হচ্ছে। কয়েক শত দালালের সহযোগিতায় গড়ে উঠা সংঘবদ্ধ চক্রের সহায়তায় বিজিবি বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গা আনতে পারলেই টাকা। আর সেই টাকার জন্য মরিয়া হয়ে সাগর উপকুল বা নাফনদীর কিনারে-কিনারে পাহারায় নিজস্ব লোকজনও নিয়োগ করেছে চক্রটি। সেই পাহারাদাররাই বিজিবি সহ অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গতি-বিধি নজর রাখেন আর তথ্য জানিয়ে দেন নৌকা বা ট্রলারের লোকজনকে। সেই ট্রলারের মাঝি সুযোগ বুঝেই মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা নিয়ে এসে নামিয়ে দেন ঘাটে।

মূলত টেকনাফ ও উখিয়ার চিহ্নিত একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সাথে মিয়ানমারের সদস্যদের যোগাযোগের ভিত্তিতেই পরিচালিত হচ্ছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের এই কাজটি। আর সেই সব দালালরা আর কেউ নন, যারা দীর্ঘদিন ধরে সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার আর মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার করে আসছে তারাই এখন ব্যবহার হচ্ছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রেও।

টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে গত এক মাসে নতুন করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের অন্তত ২০ জনের সাথে আলাপ করেই মিলেছে এমন তথ্য। আবার এসব রোহিঙ্গাদের একটি অংশ যেমন মিলেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্বজনদের বাড়িতে। আবার আরেকটি অংশের সাথে আলাপ হয়েছে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসায়।

মঙ্গলবার সকালে টেকনাফের আলীখালিস্থ ২৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৫ নম্বর ব্লকে গিয়ে দেখা মিলে মিয়ানমারের মংডু’র নলবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ হানিফের। তিনি গত ৮ আগস্ট পালিয়ে এসে পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন এ স্বজনের বাড়িতে।

তিনি বলেছেন, মিয়ানমারের দুই পক্ষের সংঘাতে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছে। ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত, বোমা ও গুলিতে জীবন রক্ষায় রোহিঙ্গারা এখন বিপন্ন। এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সাথে দালালদের সদস্য রোহিঙ্গাদের সাথে আলাপ করে টাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর টেকনাফ থেকে নৌকা বা ট্রলার নিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসছে। তার পরিবারের সদস্যরা জনপ্রতি বাংলাদেশি ২৮ হাজার টাকা করে দেয়ার পর তার একটি নৌকায় তুলে বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে হাবির ছড়া ঘাটে নামিয়ে দেন। ওইখানে নেমে আরেকটি চক্রকে জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা দিলে তারা কয়েকবার গাড়ি বদল করে তাদের ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়।

তবে তিনি দালালদের কারও নাম বলতে পারেননি। মিয়ানমারের যে সদস্যের মাধ্যমে এই দালাল চক্রের সন্ধান পেয়েছেন ওই সদস্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পেরই বাসিন্দা। প্রায়শ মিয়ানমার-টেকনাফে আসা-যাওয়া করে। জড়িত রয়েছেন ইয়াবা কারবারেও। ওই যুবকের নাম হেলাল উদ্দিন বলে জানান তিনি।

ক্যাম্পে পাওয়া নতুন রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার গল্প যেন এক এবং অভিন্ন। আর এসব দালালদের টাকা দিয়ে টেকনাফের বিভিন্ন ভাড়া বাড়িতেও থাকার সুযোগ পাচ্ছেন রোহিঙ্গারা।

টেকনাফের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষ বলছেন, মুলত জেলে সেজে মাছ ধরার ইঞ্জিল চালিত নৌকাযোগেই আনা হচ্ছে এসব রোহিঙ্গাদের। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিভিন্ন মাধ্যমে ৩০ পয়েন্টের কথা বলা হলেও এর সংখ্যা কম হলেও ৫৫ টি।

এর মধ্যে টেকনাফের সাগর উপকুল শাপলাপুর, শীলখালি, চৌকিদার পাড়া, মারিশবনিয়া, হলবনিয়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া,বাঘগোনা, নোয়াখালী পাড়া, রাজারছড়া, হাবিরছড়া, মিঠাপানির ছড়া, লম্বরি, লেঙ্গুরবিল, তুলাতুলি, মহেশখালীয়া পাড়া, মুন্ডারডেইল ঘাট, খুরেরমূখ, জিরোপয়েন্ট, শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিম পাড়া, ডাঙ্গর পাড়া, নাফনদীর মিস্ত্রি পাড়া, গোলা পাড়া, শাহপরীরদ্বীপ জালিয়া পাড়া, নয়াপাড়া-ঝিনা পাড়া, টেকনাফ সদরের নাজির পাড়া, মৌলভী পাড়া, ট্রানজিট, বরইতলী, কেরুনতলী, হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া ১৪নং ব্রীজ, দমদমিয়া কেয়ারী ঘাট, দমদমিয়া হাজীর খাল,ন্যাচার পার্ক, দমদমিয়া ওমরখাল, জাদিমুড়া, জাইল্যা ঘাট, মুচনি ঘাট, হ্নীলা চৌধুরীপাড়া, হ্নীলা জালিয়া পাড়া, উয়াব্রাং, মৌলভীবাজার, হোয়াইক্যং খারাংখালী, নয়াবাজার, মিনাবাজার, ঝিমংখালী, কাঞ্জরপাড়া, উনছিপ্রাং, লম্বাবিল, বালুখালী, কেরুনতলী, উলুবনিয়া ঘাট ব্যবহার করেই দালালরা নিয়ে আসছেন এসব রোহিঙ্গা।

এসব দালাল কারা ? এমন প্রশ্নের উত্তরে সাবরাং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ সেলিম বলেন, শত শত দালাল। রাত হলেই এসব দালালদের আনাগোনা বাড়ে সাগর উপকুল বা নাফ নদীর কিনারে। বিজিবির অবস্থান, অন্যান্য আইন শৃঙ্খলার বাহিনীর টহল নজরদারী করেই সংকেত দিলেই নৌকা নির্ধারিত ঘাটে ভিড়ানো হয়।

মিয়ানমারের সাথে ইয়াবা কারবারি জড়িত ব্যক্তি, সাগর পথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারকারি দালালরা এই নিয়ন্ত্রক। নৌকা আনা-নেয়ার কাজ ঘরে বসেই নিয়ন্ত্রণ করে দালালদের প্রধান বা গডফাদার। মাঠের নজরদারীকারি, নৌকায় জেলে সেজে আনায় জড়িত ব্যক্তিরা পাচ্ছেন একটা কমিশন।

টেকনাফের ৮ জন জনপ্রতিনিধি সহ ২৫ জন মানুষের সাথে আলাপ করে দালাল কারা শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কেউ নাম প্রকাশ করতে চান না। বলে শত শত দালাল কাদের নাম বলবো?
শেষ পর্যন্ত নাম প্রকাশ না করার শর্তে দালাল চক্রেরই কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, কোন ঘাটে নৌকা আসছে এটা বড় না। সব ঘাটেই মিলে মিশে এই কাজটি করা হচ্ছে। আগে থেকে ইয়াবা বা মানবপাচারে সংঘবদ্ধ এসব চক্র। তবে ঘাট ভিত্তিক নিয়ন্ত্রক ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির রয়েছে। যেখানে জড়িত রয়েছেন জনপ্রতিনিধি সহ প্রভাবশালীরাও।

এদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে তারাও ঘুরে-ফিরে মানবপাচার মামলা ও ইয়াবা পাচার মামলার আসামি। টেকনাফের সাগর উপকুলের ঘাট সমুহ বদি আলম, হেলাল উদ্দিন, মো. রহিম বাদশা, মো. বলি, নুর মোহাম্মদ, মোহাম্মদ সালমান, মো. শামসুল আলম, মো. জাবেদ, ইমান হোসেন ইউচুপ, মো. ইউনুছ, মো. সিরাজ, আজিজ উল্লাহ, জাফর আলম, মো. জিয়াবুল, মো. শফিক, মুহাম্মদ মান্নান, করিম উল্লাহ, নজির আহমেদ, মো. শফিক, মো. ফারুক, মো. জয়নাল, নুর হোসেন, মো. সাদ্দামরা নিয়ন্ত্রণ করলেও নাফনদী নিয়ন্ত্রণে ভিন্ন নাম পাওয়া যায়।

নাফনদীর ঘাট সমুহ নিয়ন্ত্রণ করছেন মো. মিজান, মো. নজির, শফিউল্লাহ, আককাজ, নুর হাকিম সহ কয়েক জন।

আবার ঘাট দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভাড়া বাড়ি বা ক্যাম্পে পৌঁছানোর চক্রটি রয়েছে জালাল হোসেন, খোরশেদ আলম, ইয়াসিনদের মতো যুবকরা।

টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেন, ‘এটা সত্য যে আমার এলাকাসহ বিভিন্ন গ্রামে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে। অনেকে ভাড়া বাসায় থাকছে। দালালরা তাদের সহযোগিতা করছেন। এসব বিষয়ে আমি আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে একাধিকবার অবহিত করেছি। এরপরও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমরা স্থানীয় বাসিন্দা অনিরাপদ আছি। কেননা ওপার থেকে অনেকে সশস্ত্র ধারী সন্ত্রাসী পালিয়ে আসার খবর পেয়েছি। এখনিই এটি ব্যবস্থা না নিয়ে সামনে আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।’

বিজিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের দালালদের শনাক্ত করতে কাজ শুরু করেছেন তারা। এর মধ্যে ৫৭ জনকে চিহ্নিত করে একটি তালিকা তৈরি করেছে। কয়েকজনকে আটকও করা হচ্ছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী বলেন, টেকনাফ শহরসহ রোহিঙ্গারা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে অতি দ্রুত যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের জনবল বাড়াতে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। দালালদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

  • ডেইলি কক্সবাজার •