‘ইয়াবা ডন’ কারাগারে, বীরদর্পে শীর্ষ কারবারিরা

ডেস্ক রিপোর্ট :

কক্সবাজার ৪ সংসদীয় আসন (উখিয়া-টেকনাফ) থেকে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়নে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আবদুর রহমান বদি।

এরপর ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনেও একই দলের নির্বাচিত এমপি তিনি। নিজেই দুই বারের সংসদ সদস্য হওয়ার পর নানা বিতর্ক ও দূর্নীতির মামলায় দলীয় মনোনয়ন না পেলেও মনোনয়ন ভাগিয়ে নেন নিজের স্ত্রী শাহিন আকতারের নামে। শেষ দুই বার ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে তার স্ত্রীই এ আসনের এমপি।

ফলে টানা ১৫ বছরের একক ক্ষমতাবলে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফের ডন হয়ে উঠেন আবদুর রহমান বদি। তিনি নিজেই এমপি থাকা অবস্থায় সরকারের করা প্রথম মাদকদ্রব্য ইয়াবা কারবারিদের একটি তালিকা প্রকাশিত হয় বিগত ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওই সময়ের পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) প্রণব কুমার নিয়োগী স্বাক্ষারিত তালিকাটিতে সীমান্তে ভয়াবহ মাদক ইয়াবা সংশ্লিষ্ট ৭৬৪ জনের নাম ঠিকানা প্রকাশ করা হয়। ২৮ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনটিতে এর পেছনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উল্লেখ ছিল ওই সময়ের আওয়ামীলীগের দলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির নাম।

প্রতিবেদনটি প্রথম পৃষ্ঠায় বলা হয়েছিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা ৬ এর ৩০ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে প্রেরিত পত্রে এই তালিকাটি তৈরি করা হয়।

ওই প্রথম তালিকাটি প্রকাশের পর আওয়ামীলীগের ক্ষমতার সময় পৃথকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকাশিত অন্তত ৫ টি তালিকায় ঘুরে-ফিরে ইয়াবার প্রধান ডন হিসেবে আবদুর রহমান বদির নাম উল্লেখ ছিল। যদিও সর্বশেষ গত ২০২২ সালের ডিসেম্বরের প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ইয়াবা কারবারির সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ১২৭৫ জনকে।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবদুর রহমান বদিই সীমান্তের ইয়াবা নিয়ন্ত্রক এবং সকল কারবারিরা তার নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হয়।
ছাত্র জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর একটি হত্যা চেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তারের পর কারাগারে রয়েছেন বহুল আলোচিত সীমান্তের এই সাবেক সংসদ সদস্য। এরপর থেকে আলোচনায় আসছে সীমান্তের অন্যান্য ইয়াবা কারবারিরা কেমন আছেন এবং কোথায় আছেন? এমন প্রশ্ন।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, পুলিশ সহ অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় ভাটা সহ নানা কারণে বহুল আলোচিত ইয়াবা ডন বদি কারাগারে থাকলেও থেমে নেই ইয়াবা পাচার। চিহ্নিত শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা পুরোদমে ইয়াবা পাচার অব্যাহত রেখেছে।

এর মধ্যে গত ১০দিনে পাঁচ লক্ষাধিক ইয়াবা, ৩ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস, বিদেশী পিস্তল উদ্ধার করে বিজিবি সদস্যরা। পৃথক অভিযানে র্যাহব উদ্ধার করে আরও অন্তত দেড় লাখ ইয়াবা।

টেকনাফ সীমান্তের একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, পট পরিবর্তনের প্রভাব পড়েনি সীমান্তে। বীরদর্পে ইয়াবা কারবার অব্যাহত রেখেছে চিহ্নিত কারবারিরা। এর মধ্যে নিজেকে ইয়াবা কারবারি হিসেবে স্বীকার করে আত্মসমর্পনকারিরাও পুরোদমে ইয়াবা পাচার অব্যাহত রেখেছে। আবার এদের মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিকভাবে সুবিধা আদায়ের জন্য বিএনপিতে যুক্ত হতে চেষ্টাও শুরু করেছে।

টেকনাফে একাধিক ব্যক্তির দেয়া তথ্য বলছে, সরকারের একটি পর একটি তালিকা প্রণয়ন, টেকনাফ থানায় ওসি হিসেবে প্রদীপ কুমার দাশের যোগদানের পর একের পর এক ক্রসফায়ারের নামে নিহত হওয়ার ঘটনা টেকনাফ আতংকের জনপদে পরিণত হয়। এর প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ জন, এবং ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ২১ জন নিজেকে ইয়াবা কারবারি হিসেবে স্বীকার করে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন।

এর মধ্যে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতিতে ১০২ জন আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারি ও গডফাদার সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবা, ৩০ টি দেশীয় তৈরি বন্দুক ও ৭০ রাউন্ড গুলিসহ আত্মসমর্পণ করেন। ওইদিনই আত্মসমর্পণকারী ১০২ জনকে আসামী করে টেকনাফ মডেল থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা দায়ের করা হয়। বাদী হয়ে মামলাটি করেন টেকনাফ থানার তৎকালীন পরিদর্শক (অপারেশন) শরীফ ইবনে আলম। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় পরিদর্শক এবিএমএস দোহাকে। মামলা দায়েরের দিনই আদালতের মাধ্যমে সকল আসামীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কক্সবাজার জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। ১০২ জন আসামীর মধ্যে মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট মোহাম্মদ রাসেল নামে এক আসামী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্ন ফারাহ এর আদালত ১০১ আসামীর বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। পরবর্তীতে মামলাটি বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রেরণ করা হয়। একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল সকল আসামীর উপস্থিতিতে শুনানী শেষে মামলার চার্জ গঠন করেন। বিচার শেষে ২৩ নভেম্বর এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।

কিন্তু ওই রায়ে মাদক মামলায় প্রত্যককে ১ বছর ৬ মাসের কারাদন্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা প্রদান করা হয়। একই সঙ্গে অস্ত্র মামলায় সকলকে খালাসের আদেশ দেয় আদালত। এতে একজনকেও নতুন করে সাজা ভোগ করতে হয়নি। ঘোষিত রায়ে ১০১ আসামির হাজতবাস সাজার অধীনে হওয়ায় নতুন করে সাজা ভোগ করতে হয়নি। ফলে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে করা ২০ হাজার টাকা জরিমানা প্রতিশোধ করেই খালাস পেয়ে যান তারা।

এই রায়ের পর টেকনাফে ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে উল্লাস শুরু হয়। সকলেই বীরদর্পে শুরু করেন পুরাতন কারবার। অনেকেই নতুন করে ইয়াবা সহ গ্রেপ্তারও হয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত তালিকায় ইয়াবা কারবারিরা চিহ্নিত থাকলেও কোনভাবেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়নি। এতে বর্তমান ও সাবেক সংসদের ভাই ও পুত্র, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক দলের নেতা, পৌরসভার কাউন্সিলর, স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকের নামও রয়েছে। মুলত সরকারদলীয় সংসদ, তার সমর্থিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট আত্মীয়-স্বজনরাই ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে এদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলেই উল্টো হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে।

পুলিশের দেওয়া তথ্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় আব্দুর রহমান বদি ছাড়াও তার তিন ভাই আব্দুল আমিন, মৌলভী মুজিবুর রহমান, আব্দুস শুক্কুর, টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদ ও তার পুত্র শাহজাহান, দিদার হোসেন, বদির ভাগনে মো. সাহেদ রহমান নিপু, আব্দুল আমিন, নুরুল আমিন, বদির ভাই শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক, বদির ভাই ফয়সাল রহমান, এনামুল হক ওরফে এনাম মেম্বার, একরাম হোসেন, ছৈয়দ হোসেন, বদির বেয়াই সাহেদ কামাল ওরফে সাহেদ, মৌলভী বশির আহমদ, আব্দুর রহমান, মোজাম্মেল হক, জোবাইর হোসেন, নুরুল বশর ওরফে কাউন্সিলার নুরশাদ, বদির ফুপাত ভাই কামরুল হাসান রাসেল, বর্তমানে জিয়াউর রহমান, মোহাম্মদ শাহ, নুরুল কবির, মারুফ বিন খলিল ওরফে বাবু, মোহাম্মদ ইউনুচ, ছৈয়দ হোসেন ওরফে ছৈয়দু, মোহাম্মদ জামাল ওরফে জামাল মেম্বার, মোহাম্মদ হোছাইন, মো. হাসান আব্দুল্লাহ, রেজাউল করিম ওরফে রেজাউল মেম্বার, মো. আবু তাহের, রমজান আলী, মোহাম্মদ আফছার, হাবিবুর রহমান ওরফে নুর হাবিব, শামসুল আলম ওরফে শামশু মেম্বার, মোহাম্মদ ইসমাঈল, আব্দুল গনি, মোহাম্মদ আলী, জামাল হোসেন, আব্দুল হামিদ, নজরুল ইসলাম, মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে দানু, মোহাম্মদ সিরাজ, মোহাম্মদ আলম, মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, হোসেন আলী, নুরুল কবির মিঝি, শাহ আজম, জাফর আহমেদ ওরফে জাফর, রুস্তম আলী, নুরুল আলম, শফি উল্লাহ, মো. জহুর আলম, মোহাম্মদ হুসাইন, মোহাম্মদ সিদ্দিক, রবিউল আলম, মঞ্জুর আলী, হামিদ হোসেন, মোহাম্মদ আলম, নুরুল আমিন, বোরহান উদ্দিন, ইমান হোসেন, মোহাম্মদ হারুন, শওকত আলম, হোছাইন আহম্মদ, মোহাম্মদ আইয়ুব, মো. আবু ছৈয়দ, মো. রহিম উল্লাহ, মোহাম্মদ রফিক, মোহাম্মদ সেলিম, নুর মোহাম্মদ, বদির খালাত ভাই মং অং থেইন ওরফে মমচি, মোহাম্মদ হেলাল, বদিউর রহমান ওরফে বদুরান, ছৈয়দ আলী, মোহাম্মদ হাছন, নুরুল আলম, আব্দুল কুদ্দুস, আলী আহম্মেদ, আলমগীর ফয়সাল ওরফে লিটন, জাহাঙ্গীর আলম, নুরুল আলম, সামছুল আলম শামীম, মোহাম্মদ ইউনুচ, নুরুল আফসার ওরফে আফসার উদ্দিন, মোহাম্মদ শাহজাহান আনছারী, নুরুল হুদা, শাহ আলম, আব্দুর রহমান, ফরিদ আলম, মাহবুব আলম, রশিদ আহমেদ, মোহাম্মদ তৈয়ব, জাফর আলম, মোহাম্মদ হাশেম ওরফে আংকু, আবু তৈয়ব, আলী নেওয়াজ, মোহাম্মদ আইয়ুব, কামাল হোসেন, নুরুল বশর ওরফে কালাভাই, আব্দুল করিম ওরফে করিম মাঝি, দিল মোহাম্মদ, মো. সাকের মিয়া ওরফে সাকের মাঝি সহ অনেকেই রয়েছেন। যারা এখন পুরোদমে প্রকাশ্যে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

আর এদের আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণের বদির কৌশল সহ নানা অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করে স্বয়ং পুলিশের এক কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, সময় পরিবর্তনের পর এদের গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি হয়ে পড়েছে।

  • ডেইলি কক্সবাজার •

আরও খবর