কক্সবাজারে ৪১ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ১৮ লাখ!

লোকমান হাকিম •

  • প্রতি বর্গকিলোমিটারে ঘনত্ব বেড়েছে ২১৪ জন, বাড়েনি আয়তন

  • জলবায়ু পরিবর্তন ও শিল্পায়নের প্রভাবে বেশি শহরমুখী হচ্ছেন

  • বড় চাপ পড়ছে পরিবেশের ওপর

  • শহরকে সম্প্রসারণ ও সরকারি সেবা উপজেলায় বন্টনের পরামর্শ

গেল এক চল্লিশ বছরের ব্যবধানে কক্সবাজার জেলায় যোগ হয়েছে আঠারো লাখ জনসংখ্যা। এক চল্লিশ বছর আগে ১৯৮১ সালে এ জেলার জনসংখ্যা ছিল ১০ লক্ষ ২৬ হাজার ১৭২ জন। বিবিএসের সর্বশেষ শুমারি অনুয়ায়ী, জেলার মোট জনসংখ্যা ২৮ লাখ ২৩ হাজার ২৬৮ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়, গেল তিন দশকে শহরাঞ্চলে নগরায়ন বৃদ্ধি পেলেও কক্সবাজারের আয়তন বাড়েনি।

বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কক্সবাজারের উপকূলীয় উপজেলাগুলো থেকে অনেকে অভ্যন্তরীণ অভিবাসী হচ্ছেন। তাদের মধ্যে কর্মক্ষেত্র ও উন্নত জীবনের আশায় শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া শিল্পায়নের প্রভাবে ভূমি হারিয়ে অনেকে শহরাঞ্চলে ভীড় করার কারণে নানা সংকট তৈরী হচ্ছে ।

গত ২৬ জুন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে জনশুমারি ২০২২ এর চুড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে পরিসংখ্যান ব্যুরো। প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৮১ সালে শহরাঞ্চল অর্থাৎ চকরিয়া, কক্সবাজার, মহেশখালী ও টেকনাফ চার পৌরসভায় বসবাসের হার ছিল ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। বর্তমানে এই হার ঠেকেছে ৪৩ দশমিক ৬২ শতাংশে। অথচ, দেশে সার্বিক শহরাঞ্চলে বসবাসের হার ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ (১১ জুলাই) কক্সবাজারসহ সারাদেশে পালিত হবে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উপাত্ত ব্যবহার করি, সাম্যের ভিত্তিতে সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ি’।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২২ সালের সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী কক্সবাজারে মোট জনসংখ্যা ২৮ লাখ ২৩ হাজার ২৬৮ জন। মোট জনসংখ্যার মধ্যে ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৬২২ জন পুরুষ এবং ১৩ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬৩ জন নারী। প্রতিবেদন মতে, মোট জনসংখ্যার ১৫ লক্ষ ৯১ হাজার ৬২৯ জন গ্রামাঞ্চলে ১২ লক্ষ ৩১ হাজার ৬৩৯ জন শহরাঞ্চলে বাস করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালের শুমারিতে জনসংখ্যা ছিল ২২ লক্ষ ৮৯ হাজার ৯৯০ জন। ২০০১ সালে ছিল ১৭ লক্ষ ৭৩ হাজার ৭০৯ জন। ১৯৯১ সালে ছিল ১৪ লক্ষ ১৯ হাজার ২৬০ জন এবং ১৯৮১ সালে ছিল ১০ লক্ষ ২৬ হাজার ১৭২ জন। স্বাধীনতার পর চারটি শুমারির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ৪২ বছরে এ জেলায় ১৮ লক্ষ ৯৬ জন যোগ হয়েছেন।

ঘনত্ব বেড়েছে ২১৪ জন, বাড়েনি আয়তন
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে গণনায় নতুন যুক্ত হওয়াদের মধ্যে ২ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫৪৪ জন পুরুষ এবং ২ লক্ষ ৯৫ হাজার ৬৫১ জন নারী। বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ১ হাজার ১৩৩ জন। ২০১১ সালের শুমারিতে ছিল ৯২০ জন। অর্থাৎ গত ১০ বছরে প্রতি কিলোমিটারে ঘনত্ব বেড়েছে ২১৪ জন।

প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে, পৌর শহরগুলোতে নগরায়ন বৃদ্ধি হলেও ১৯৯১ সালের পর কক্সবাজার জেলার আয়তন বাড়েনি, বরং কমেছে। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে এ জেলার আয়তন ছিল ২৪৯১. ৮৬ বর্গকিলোমিটার। তবে ২০১১ ও ২০২২ সালে কক্সবাজারের আয়তন উল্লেখ করা হয়েছে ২৪৯১. ৮৫ বর্গকিলোমিটার। সেই হিসেবে শুন্য দশমিক ১ শতাংশ জেলার আয়তন কমেছে।

কমেছে জন্মহার
প্রতিবেদন বলছে, কক্সবাজার জেলার গড় বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। জাতীয় পর্যায়ে এ হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ। লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনে পুরুষের বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৮২ শতাংশ ও নারীর ক্ষেত্রে ১ দশমিক ৯১ শতাংশ। ২০১১ সালের শুমারিতে জন্মহার ছিল ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। সেই হিসেবে জন্মহার কমেছে শুন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ।

উপজেলাভিত্তিক বিশ্লেষণে, কক্সবাজার সদরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে ঋণাত্মক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় যা -০ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

কোন উপজেলায় কত জনসংখ্যা
প্রতিবেদন বলছে, চকরিয়ার মোট জনসংখ্যা ৫ লক্ষ ৭১ হাজার ২৮০ জন। কক্সবাজার সদরে ৪ লক্ষ ১৭ হাজার ৩৬৫ জন। ঈদগাঁওতে ১ লক্ষ ৪৯ হাজার ৫৬৬ জন। কুতুবদিয়ায় ১ লক্ষ ৪৩ হাজার ৬২২ জন। মহেশখালীতে ৩ লক্ষ ৮৫ হাজার ৫১০ জন। পেকুয়ায় ২ লক্ষ ১৪ হাজার ৩৫৭ জন। রামুতে ৩ লক্ষ ৪৪ হাজার ৫৪৫ জন। টেকনাফে ৩ লক্ষ ৩৩ হাজার ৮৬৫ জন ও উখিয়া উপজেলায় ২ লক্ষ ৬৩ হাজার ১৫৮ জন।

চার সদস্যের পরিবার বেশি
জেলার মোট পরিবার ৫ লক্ষ ৭৬ হাজার ৭৩০টি। এর মধ্যে ১ জনের পরিবার ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৮৬টি। ২ জনের পরিবার ৪৫ হাজার ৫১৯টি। ৩ জনের পরিবার ৯৩ হাজার ৪৬৪টি। ৪ জনের পরিবার ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৩০৮টি। ৫ জনের পরিবার ১ লক্ষ ২৩ হাজার ৪৩০টি। ৬ জনের পরিবার ৮২ হাজার ১২৫টি। ৭ জনের পরিবার ৪২ হাজার ৪৫৬ টি। ৮ জনের পরিবার ২০ হাজার ৬৩১টি। ৯ জনের পরিবার ১০ হাজার ৩৪৫ টি। ১০ জনের পরিবার ৫ হাজার ৮৮৬টি। ১০ জনের অধিক পরিবার ৮ হাজার ৩৮০টি।

শহরে বাড়ছে নানামুখী চাপ

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আবাসনহ পাঁচটি মৌলিক চাহিদা ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির নানা সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির চাপ বাড়ছে। খাদ্যের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি, বিদ্যুতের ওপর চাপ বাড়ছে। অবকাঠামো উন্নয়নে চাপ আছে সেবা সংস্থাগুলোর ওপর। বিশিষ্টজনেরা মনে করেন চাপ মোকাবেলায় দরকার সবন্বিত প্রচেষ্ট।

জানতে চাইলে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘কক্সবাজার প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ জেলা। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত উদ্ধাস্তের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কুতুবদিয়াপাড়া, আশ্রয়ণ প্রকল্প সবকিছু পৌরসভার মধ্যে ঢোকে গেছে। মানুষ শহরমুখী হওয়া এক প্রকার চ্যালেঞ্জের।’

তার মতে, জনসংখ্যার আধিক্য কমানো যাবে না। বাসস্থান, অবকাঠামোগত নিশ্চিতে সুষ্ঠু কমপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য তিনি কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেছেন। যার মধ্যে রয়েছে- উদ্ধাস্তদের বাসস্থান নিশ্চিতকরণ; আগামীতে কি পরিমাণ অভ্যন্তরীণ অভিবাসী শহরমুখী হচ্ছে তার ওপর নজর দেয়া; শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কমানো; শহরকে সম্প্রসারণ করা; সরকারি সেবা উপজেলায় বন্টন করা।

তিনি বলেন, একসময় শহরের সেবা বিকেন্দ্রীকরণ ছিল। সেবাগুলো বন্ধ হওয়াতে মানুষ কক্সবাজারমুখী হয়েছে। উপজেলাকে কার্যকর করতে পারলে শহরে চাপ কিছুটা কমবে। এসব পৌরসভা কিংবা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ করলে হবে না, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে।

বড় আঘাত পরিবেশের ওপর
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসছে পরিবেশের ওপর। পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ, পানির স্তর নিচে নামা, কৃষি জমি কমে যাওয়া, চাহিদার বিপরীতে আবাসনসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরী হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে ভূমির ওপর চাপ বাড়ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা’র) কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, ‘একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন শহরের প্রধান সমস্যা হচ্ছে জনসংখ্যা। পরিবেশ প্রকৃতি ধরে রাখতে হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে কক্সবাজারের কৃষি জমি, বনভূমি শেষ হয়ে যাচ্ছে। গত ১০ বছরে শহরে প্রায় ২ হাজার পাহাড় কাটা হয়েছে। নষ্ট হয়েছে সবুজায়ন। এটি সামনে আরো ভয়াবহ হবে।‘

কলিম উল্লাহ মনে করেন, কক্সবাজার জেলায় আগত জনগোষ্ঠির সমপরিমাণ অবকাঠামো এখনো তৈরী হয়নি।