সাফল্যে ভাস্বর আওয়ামী লীগ, ত্রুটি বিচ্যুতিও কম নয়

অমরেশ রায় :

রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সাফল্য বহুমুখী, রয়েছে অনেক অর্জন। দলটি দেশের বহু উন্নয়ন স্মারকের সঙ্গী। তবে লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহ্যে লালিত আওয়ামী লীগের ত্রুটি-বিচ্যুতিও কম নয়।

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দলে এখন বিপর্যস্ত এর সাংগঠনিক কাঠামো। দুর্নীতি-অনিয়ম-লুটপাট, ব্যাংক খাতে ধস, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে বেশ চাপে রয়েছে টানা চার মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ বলে মনে করেন অনেকে। গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল আদর্শে প্রতিষ্ঠিত দলটির বিরুদ্ধে আদর্শবিচ্যুতি ও আপসকামিতার অভিযোগও উঠছে।

এমন পরিস্থিতিতে আজ রোববার দেশের অন্যতম প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী ও বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর তথা প্লাটিনাম জয়ন্তী উদযাপন করছে। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন পুরান ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনে জন্ম হয় পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। নতুন নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার পর দলটির নাম হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, এ দেশের সব অর্জন, আন্দোলন-সংগ্রাম ও ইতিহাসে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগের নাম। তবে দীর্ঘ পথচলায় ব্যর্থতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সমালোচনা কম কুড়ায়নি দলটি। সব মিলিয়ে ছয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীর ক্ষমতালিপ্সা, দুর্নীতি-লুটপাট ও অর্থসম্পদ বানানোর মোহের কাছে ম্লান হয়েছে দলের ঐতিহ্য-আদর্শ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দলীয় অঙ্গীকার মুখ থুবড়ে পড়েছে বারবার।

সাফল্য-অর্জন-অগ্রগতি
প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছরে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে গৌরবের অর্জন হলো ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা লাভ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও সরকার গঠন, বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী ও ১১ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভসহ গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসন অর্জনের সব আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ ছিল নেতৃত্বে। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে বঙ্গবন্ধু তথা আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকাও স্মরণীয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে হাল ধরেন আওয়ামী লীগের। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই নব্বইয়ের গণআন্দোলনে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতসহ প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও ২০০৭-এর ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিরোধী আন্দোলনেও বিজয় আসে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে সরকার গঠন করে। ক্ষুধা-দারিদ্র্য কাটিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কাতারে। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর দেশের মানুষকে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে আওয়ামী লীগ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে আওয়ামী লীগের শাসনামলেই।

নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ; বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, পায়রা বন্দর, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর, মেট্রোরেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ; মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ; ফাইভজি সেবা চালু, মহাসড়কগুলো চার লেনে উন্নীতকরণ, দু’ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক ও আইটি ভিলেজ নির্মাণ– সবই হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে।

শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত; দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ ও অতিদারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে হ্রাস; মাথাপিছু গড় আয় ২ হাজার ৭৮৪ ডলার ও রেমিট্যান্স ২১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীতকরণ; গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত করতে গুচ্ছগ্রাম, আশ্রয়ণ ও ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প; বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা চালু ইত্যাদি হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই।

দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু এমপি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এ দেশের মাটি ও মানুষের দল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছে আওয়ামী লীগ। তবে বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করতে পারলেও কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেননি। তাঁর সে অসমাপ্ত কাজ এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমাপ্ত হচ্ছে। দেশকে উন্নয়নের সোপানে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন– বাঙালি জাতি যা ইচ্ছা করে, সেটাই বাস্তবায়ন করে।’

কোন্দলে বিপর্যস্ত দল, চাপে সরকার
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনও উন্মুক্ত করে। এমন কৌশলে ভোটার উপস্থিতি বাড়লেও দলের অভ্যন্তরে নতুন দ্বন্দ্ব-কোন্দল দেখা দিয়েছে। দলীয়প্রধান শেখ হাসিনাসহ হাইকমান্ডের নির্দেশেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির স্বজনের অংশগ্রহণ ঠেকানো যায়নি। এতে দলের তৃণমূল পর্যায়ে শৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।

সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিপুল অর্থ-সম্পদ ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ক্ষমতার অপব্যবহারের তথ্য প্রকাশ্যে আসায় ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে আওয়ামী লীগ। ভারতে গিয়ে এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার খুন হওয়ার ঘটনায় তৈরি হয়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতি।

দেশের অর্থনীতিও চাপে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে সরকারকে বাজেটের ঘাটতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকারের দুর্বলতা স্পষ্ট। সর্বশেষ হিসাবে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা, সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে হতাশা।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে গণতন্ত্র, কার্যকর সংসদ এবং সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূলের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হলেও সেই অর্জন এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। বিরোধী দলের আন্দোলন ও সভা-সমাবেশ এবং সরকারবিরোধী নেতাকর্মীর ওপর পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের হামলা-মামলার ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মতপ্রকাশে প্রতিবন্ধকতার ঘটনাপ্রবাহ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। জঙ্গিবাদ নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার সফল হলেও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন, প্রতিমা ভাঙচুর এবং গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা আওয়ামী লীগ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীর টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার ঘটনা আওয়ামী লীগের অনেক বড় অর্জনকে স্তিমিত করে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারী দল। মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দলটির প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বর্তমানে দলটি আর ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনৈতিক দল নেই। ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় দেশটা দুর্নীতিবাজ-লুটেরা ও বাজিকরের দেশে পরিণত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে নতুন করে জন্ম নিতে হবে। দলের ভেতরের ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করে দুর্নীতিবাজ, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, লুটেরা, অপরাধী ও হাইব্রিড থেকে মুক্ত হতে হবে। পরিচ্ছন্ন ও গণতান্ত্রিক ধারায় দলটির পুনরুজ্জীবন ও পুনর্জন্ম দরকার।’

  • সমকাল