ডেস্ক রিপোর্ট :
২০১৮ সালের ২৬ মে, গভীররাত। কক্সবাজারের টেকনাফে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন একরামুল হক। যিনি টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। মাদককারবারি দেখিয়ে একরামকে বন্দুকযুদ্ধে হত্যার ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এর কারণ, ঘটনার সময়ের (বন্দুকযুদ্ধের) একটি অডিও (কলরেকর্ড) ফাঁস হয়। যা সাধারণ মানুষের মনে দাগ কাটে।
আলোচিত সেই ঘটনার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু ঘটনায় জড়িত কাউকে এখনো শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হয়নি। একরামকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল পুরো পরিবার। দীর্ঘদিন একরাম হত্যার বিচারের কোনো অগ্রগতি না পেয়ে বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন তার স্ত্রী ও সন্তানরা। র্যাুবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত একরাম দুই কন্যা সন্তানের বাবা ছিলেন। এরমধ্যে একজন তাহিয়াত হক অপরজন নাহিয়ান হক। বাবার মৃত্যুর সময় তারা দুইজনই স্কুলপড়ুয়া ছিলেন। এখন তারা কলেজ শিক্ষার্থী। একরামকে বন্দুকযুদ্ধে যারা হত্যা করেছে ভয়ে এখনো তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেনি পরিবারটি। তাদের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারলে একরাম হত্যার সুরাহা হবে।
একরাম কথিত এক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে র্যা বের পক্ষ থেকে বক্তব্য আসার তিন দিনের মাথায় (৩০মে) তার স্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে তিনটি অডিও প্রকাশ করেন। তা সত্যি হোক বা মিথ্যে হোক, বোমা ফাটানোর মতো একটি প্রভাব ফেলে। যার ফলে চাপের মুখে পড়ে র্যা বের মাদকবিরোধী অভিযান। কারণ, ওই বছর (২০১৮ সালের ৪ মে) দেশজুড়ে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানে শুরু হয় মাদকবিরোধী অভিযান। ফাঁস হওয়া অডিওতে গুলি ও গোঙানির শব্দ শোনা যায়। যা একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়ার মতো ছিল না।
একরামের মৃত্যুর ঘটনায় সেসময় র্যা।ব টেকনাফ থানায় তিনটি মামলা করে। থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (বর্তমানে মেজর অব. সিনহা হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড নিয়ে কারাগারে আছেন) প্রদীপ কুমার দাস সেসময় বলছিলেন, র্যা বের করা মামলার ভিত্তিতে তদন্তের কাজ চলছে, তবে পরিবারের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ আসেনি।
প্রদীপ কুমার দাস আরও বলেছিলেন, ‘তদন্ত চলছে, তদন্তের স্বার্থে কিছু বলা যাবে না। তবে যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষ চার্জশিট দেয়া হবে। আর একটি মামলা থাকা অবস্থায় আরেকটি মামলা হয় না। তারপরেও এই মামলাটি আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।’ ঘটনাস্থল থেকে র্যাষব ১০ হাজার পিস ইয়াবা ও দুটি বন্দুক উদ্ধারের দাবি করে।
এদিকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র একরামকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যা্বের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ ও র্যা্ব-৭ এর সাবেক অধিনায়ক মিফতা উদ্দিন আহমেদের নামে নিষেধাজ্ঞা দেয়, যা এখন বহাল আছে।
টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে র্যা্বের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একরাম নিহত হওয়ার পর বাহিনীটির দাবি ছিল, তিনি মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। তবে এই হত্যার ঘটনার পর থেকেই তার স্ত্রী আয়েশা বেগম ও স্বজনরা দাবি করে আসছেন, নির্দোষ একরামকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান রিয়াজুল হকসহ র্যা্ব ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দেন একরামের পরিবারকে। কিন্তু সে আশ্বাস পূরণ হয়নি আজও।
সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছিল একরামের স্ত্রী:
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আয়েশা বলেন, ‘২৬ মে রাতে একটি গোয়েন্দা সংস্থার মেজর পরিচয় দিয়ে একরামকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় আমার স্বামী মোবাইলে আমার মেয়ে ও আমার সঙ্গে কথা বলেন। তখন তার কণ্ঠে আতঙ্ক ছিল। এরপর থেকে আমার মোবাইলটি সারাক্ষণ খোলা ছিল। এতে রেকর্ড হচ্ছিল। ওই দিন রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চিৎকার ও গুলির শব্দ শুনেই আমি ও আমার পরিবার আঁতকে উঠি। তখনই বুঝতে পারি আমার স্বামীকে অন্যায়ভাবে গুলি করে হত্যা করেছে র্যাহব।’
বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে আয়েশা জানান, একরামের মৃত্যুর পর বিরাট দুর্দশায় পড়েছেন তিনি। আর একরামের এমন কোনো সম্পদ নেই, যা দিয়ে দুই মেয়ের লেখাপড়া ও সংসার চলবে। তার স্বামী যেদিন নিহত হন, সেদিনও মোটরসাইকেলের তেল কিনেছিলেন ৫০০ টাকা ধার নিয়ে। শ্বশুরের দেওয়া জরাজীর্ণ বাড়িতে তারা থাকেন।
অডিওতে যা ছিল:
সোয়া ১৪ মিনিটের সেই অডিও টেপে উঠে আসে ঘটনার অনেক কিছু।অডিও’র একটা অংশে শোনা যায়— ‘হ্যালো! আমি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি। আমি উনার (কাউন্সিলর একমামের) মিসেস বলতেছি, হ্যালো! হ্যালো!…’- উৎকণ্ঠায় উচ্চস্বরে এমনিভাবে কথা বলছেন মোবাইল ফোনের একপ্রান্ত থেকে। অপর প্রান্তের কথার স্বর অনুচ্চ। এর খানিক পর গুলির শব্দ উহ্ গোঙানি। এরপর আরেকটি গুলির শব্দ। এপাশে চিৎকার- ‘ও আল্লাহ’।
স্বামীর খোঁজ নেওয়ার জন্যে আয়েশা ঘটনার দিন ১১টা ৩২ মিনিটে ফোন দিলে ফোনটি রিসিভ করা হয়। কিন্তু, কাউন্সিলর একরাম কিছু বলছিলেন না। আয়েশা বলেন, ‘হ্যালো!… হ্যালো! হ্যালো কে? আমি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি। আমি উনার মিসেস বলতেছি, হ্যালো! হ্যালো!…’ এমন সময় ফোনের অপর পাশের অনুচ্চ স্বরে কথা শোনা যায়। পরক্ষণেই শোনা যায় ট্রিগার টানার শব্দও। তারপর গুলি। একপাশে ‘ও আল্লাহ’ বলে নারী ও শিশুকণ্ঠে আত্মচিৎকার শোনা যায়। ‘আমার জামাই কিচ্ছু করে নাই। আমরা বিনা দোষী।’-বলে একজন নারীর কান্না। ফোনের অপর পাশে বাঁশির ফুঁ, সাইরেনের শব্দ। আতঙ্কিত কণ্ঠে গালিগালাজের আওয়াজ। একপর্যায়ে একজন দুজন ব্যক্তির মধ্যে গুলি গণনার কথোপকথনও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। তবে এখন পর্যন্ত অডিওটি স্বতন্ত্র ভাবে যাচাই করা হয়নি।
যা বলছেন একরামের স্ত্রী:
আয়েশা বেগম বলেন, ছয় বছর হয়ে গেল জলজ্যান্ত মানুষকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হলো। কিন্তু এতে কোনো অগ্রগতি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে স্বামী হত্যার একটি কিনারা হতো। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কেউ তার সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেননি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-