ডেস্ক নিউজ :
দেশে মাদকদ্রব্যের ব্যবসায় জড়িত শীর্ষ ব্যবসায়ীদের মধ্যে ১০ গডফাদারকে আইনের আওতায় এনেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত মানি লন্ডারিং মামলা করা হয়েছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ওই ১০ জনের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। আরো সম্পত্তি ক্রোকের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিআইডিপ্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া।
তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা ৩৫টি মামলার মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে তাঁদের এই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহিষ্ণুতা থাকার পরও দেশে বিভিন্ন অভিনব কায়দায় মাদকদ্রব্যের কারবার দিন দিন বাড়ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নিয়মিত অভিযানে প্রতিদিন মাদকের খুচরা বিক্রেতা, বাহক ও সেবনকারীরা ধরা পড়ছে।
তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন আড়ালে থাকা গডফাদাররা।
কিন্তু এবারই প্রথমবারের মতো সেই গডফাদারদের আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে সিআইডি।
মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে সিআইডি ৩৫টি মামলা তদন্ত করে মাদক মামলার মূল হোতা তথা গডফাদারদের মাদক কারবার থেকে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ (ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখা), ক্রয়কৃত জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির সন্ধান পেয়েছে। এসব মামলায় অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৭৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে।
গত কয়েক বছর অনুসন্ধান করে মাদক কারবারে জড়িত ১২২ জনকে গ্রেপ্তারের পর ১০ জন গডফাদারকে শনাক্ত করেছে সংস্থাটি। ‘সিআইডির জালে মাদকের গডফাদাররা : বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত আইজিপি।সিআইডির তথ্য মতে, এই ১০ গডফাদারের লন্ডারকৃত সম্পদের পরিমাণ অন্তত ৮৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা এবং তাঁদের ক্রোককৃত ও প্রক্রিয়াধীন মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩৭ কোটি টাকা।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ‘কক্সবাজারে পর্যায়ক্রমে মাদকের সব গডফাদারকে আইনের আওতায় আনা হবে। মাদক কারবারে যাঁরা অবৈধভাবে সম্পদ ও অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তাঁদের অবৈধ সম্পদ আইনি প্রক্রিয়ায় সরকারি কোষাগারে চলে যাবে।
দেশপ্রেমিক নাগরিকদের প্রতি মাদক গডফাদারদের তথ্য সিআইডিকে দেওয়ার অনুরোধ করা যাচ্ছে।’
উল্লেখযোগ্য গডফাদাররা
১০ মামলার এই গডফাদাররা মাদক কারবার করে গড়ে তুলেছেন বিপুল পরিমাণ সম্পদ। তাঁদের মাদক কারবারের সহযোগী হিসেবে রয়েছে নিজ পরিবারের সদস্যসহ প্রতিবেশীরাও। সহযোগীদের মাধ্যমে তাঁরা সহজে মাদকের কারবার পরিচালনা করে আসছিলেন, আর গডফাদাররা থেকে যান অন্তরালে। এবার সেই গডফাদারদের মধ্যে ১০ জনকে গ্রেপ্তারসহ তাঁদের সম্পত্তি ক্রোক করেছে সিআইডি।
নুরুল হক ভুট্টো : কক্সবাজারের মাদক কারবারের অন্যতম গডফাদার নুরুল হক ভুট্টো (৩২)। তাঁর অধীন ৪২ জন সহযোগী মাদক (ইয়াবা) কারবারে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট টেকনাফ থানায় (কক্সবাজার) মামলা করা হয়। এই গডফাদারের পাচার করা অর্থের পরিমাণ প্রায় তিন কোটি টাকা। এ ছাড়া ক্রোক করা সম্পদের পরিমাণ ২.০৪৫ একর জমি এবং আড়াই কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি।
শফিক আলম ওরফে শফিক ওরফে শফি : ইয়াবার কারবারে গডফাদার শফির বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে খুলশী থানায় (সিএমপি, চট্টগ্রাম) মামলা করা হয়। এই গডফাদারের পাচার করা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি ১৪ লাখ টাকা। ক্রোক করা সম্পদের পরিমাণ ৭০০.৯৬ শতাংশ জমি, যার দলিল মূল্য পাঁচ কোটি ১১ লাখ টাকা।
শাহজাহান হাওলাদার : শাহজাহান হাওলাদারের (৫৮) নামে ২০২১ সালের ৫ নভেম্বর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে লবণচরা থানায় (কেএমপি খুলনা) মামলা করা হয়। তাঁর পাচার করা অর্থের পরিমাণ প্রায় দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। ক্রোককৃত সম্পদের পরিমাণ ০.০৯৩৬ একর জমিসহ তিনতলা বাড়ি, যার আনুমানিক মূল্য ৫০ লাখ টাকা।
শাহিন আলম : অভিযুক্ত মাদক গডফাদার গাঁজা ও ইয়াবা ট্যাবলেট কারবারি শাহিনের সহযোগীদের নাম তদন্তাধীন। তাঁর নামে ২০২৩ সালের ১৪ মার্চ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে আতাইকুলা (পাবনা) থানায় মামলা করা হয়। তাঁর পাচার করা অর্থের পরিমাণ প্রায় ছয় কোটি ২০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ক্রোকের প্রক্রিয়াধীন সম্পদের পরিমাণ একটি বাড়ি ও ১৯২.৬৭ শতাংশ জমি, যার মূল্য ৬.২০ কোটি টাকা, ক্রোকের আবেদন করা হয়েছে।
নুরুল কবির : তাঁর নামে ২০২০ সালের ২০ মার্চ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে টেকনাফ থানায় (কক্সবাজার) মামলা করা হয়। তাঁর পাচার করা অর্থের পরিমাণ ১১ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। এ ছাড়া ক্রোকের প্রক্রিয়াধীন সম্পদের পরিমাণ মোট ১৫.৫৬৫৩ একর জমি, যার আনুমানিক মূল্য পাঁচ কোটি টাকা।
মো. সিদ্দিক আহমেদ : তাঁর নামে ২০২১ সালের ২০ অক্টোবর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে টেকনাফ থানায় (কক্সবাজার) মামলা করা হয়। তাঁর পাচার করা অর্থের পরিমাণ এক কোাটি ৫০ লাখ টাকা। ক্রোকের প্রক্রিয়াধীন সম্পদের পরিমাণ ৪৮.৩৩ শতাংশ জমি এবং একটি বহুতল নির্মীয়মাণ বাড়ি, যার মূল্য আনুমানিক ২০ লাখ টাকা।
মো. নুরুল ইসলাম : তাঁর নামে গত বছরের ২২ মার্চ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে আদাবর থানায় (ডিএমপি) মামলা করা হয়। তাঁর পাচার করা অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৩ কোটি টাকা। ক্রোকের প্রক্রিয়াধীন সম্পদের পরিমাণ মোট ১৩ কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত চারটি বাড়ি, ০.৮৮ একর জমি, একটি গাড়ি ও স্বর্ণালংকার শনাক্ত হয়েছে।
পারুল : পারুলের নামে গত বছরের ৩০ অক্টোবর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে টঙ্গী পূর্ব থানায় (জিএমপি) মামলা করা হয়। তাঁর লন্ডারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় এক কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ক্রোকের প্রক্রিয়াধীন সম্পদের পরিমাণ ১৮.৬৫ শতাংশ জমি এবং একটি বাড়ি, যার মূল্য আনুমানিক এক কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
মো. ফজর আলী : এই গডফাদারের নামে ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে টেকনাফ থানায় (কক্সবাজার) মামলা করা হয়। ফজর আলীর পাচার করা অর্থের পরিমাণ প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ক্রোকের প্রক্রিয়াধীন সম্পদের পরিমাণ ০.২০৬৭ একর জমি, যার মূল্য আনুমানিক ৩৯ লাখ টাকা।
শফিক আলম ওরফে শফিক : তাঁর নামে ২০২৩ সালের ২২ মার্চ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে টেকনাফ (কক্সবাজার) থানায় মামলা করা হয়। তাঁর পাচার করা অর্থের পরিমাণ প্রায় চার কোটি টাকা। এ ছাড়া ক্রোকের প্রক্রিয়াধীন সম্পদের পরিমাণ ২৯.৩৩ শতাংশ জমি ও তিনটি বাড়ি, যার আনুমানিক মূল্য এক কোটি ১০ লাখ টাকা।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-