রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে নিয়োগ!


ব্রাদারহুড এলায়েন্স, আরাকান আর্মি (এএ) ও পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) অব্যাহতভাবে মিয়ানমার জান্তার ওপর হামলা চালিয়ে যাওয়ার ফলশ্রুতিতে সেনাবাহিনী কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ইতিহাসে প্রথমবারের মত এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।

২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে রাখাইন রাজ্যে এ এ’র সাথে যুদ্ধে জান্তা বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এ এ’র তীব্র হামলার মুখে রাখাইন রাজ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহরের পতন ঘটে। এরপর থেকে সেনাবাহিনীতে নতুন জনবল নিয়োগের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। যুবকদের সেনাবাহিনীতে যোগদানে অনীহার কারনে সামরিক জান্তা ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সব নারী-পুরুষের সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করে ১০ ফেব্রুয়ারি একটি আইন কার্যকর করে।

রাখাইন রাজ্য থেকে সেনাসদস্য সংগ্রহের জন্য সেখানকার রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর কমান্ডাররা বৈঠক করে তাদেরকে জান্তা বাহিনীর হয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। এমন এক সময়ে তাদেরকে এই প্রস্তাব দেয়া হলো যখন এ এ জান্তাকে হারিয়ে পুরো রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করছে। তাদের জানানো হয় যে এ এ’র কারনে রোহিঙ্গারা সমস্যায় রয়েছে, তাই তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়া উচিত। তাদেরকে বলা হয় যে তাদের গ্রামের কাছে যুদ্ধ শুরু হলে সেনাবাহিনী সেসব গ্রামে হামলা না চালিয়ে শুধুমাত্র রাখাইনদের গ্রামে হামলা চালাবে। এর পরও রাখাইনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বেশিরভাগ নেতা। যে সব রোহিঙ্গা সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেয়া হবে বলেও জানায় জান্তা সরকার। এ এ’র বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করে।

সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে রোহিঙ্গাদেরকে এক বস্তা চাল, নাগরিকত্বের একটি পরিচয়পত্র এবং মাসিক এক লাখ ১৫ হাজার চ্যাট বেতন দেওয়া হবে বলে জানানো হয়ে। এই ঘোষণার পরও সাধারণ রোহিঙ্গারা সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় যোগ না দেয়ায় জোরপূর্বক তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। সেনাসদস্যরা রোহিঙ্গাদের ধরার জন্য বিভিন্ন গ্রাম এবং ক্যাম্পে হানা দিচ্ছে।

ধারনা করা হচ্ছে যে, এ এ’র বিরুদ্ধে জান্তা বাহিনীর সংঘর্ষের সময় তাদেরকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হবে। সিতওয়ে এবং বুচিডং ক্যাম্প থেকে ৪০০ জন রোহিঙ্গা পুরুষকে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। জান্তা বাহিনী ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সকলের তালিকা তৈরির জন্য — বুচিডং, মংডু এবং সিত্তের গ্রাম প্রশাসক ও নেতাদের চাপ দিয়েছে। এরমধ্যে ছোট গ্রাম থেকে অন্তত ৫০ জন, বড় গ্রাম ও প্রতিটি শরণার্থী ক্যাম্প থেকে অন্তত ১০০ জনের তালিকা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে আরও ৩০০ জনের একটি তালিকা ইতিমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে।

মিয়ানমারে আভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত আরও ছয় লাখ ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এদের বেশিরভাগ জাতিসংঘের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাস করে এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেনা। রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ে শহরের ১৩ টি শিবিরে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে।

চকপিউ শহরের একটি ক্যাম্পে ফেব্রুয়ারি মাসে রোহিঙ্গাদের আদমশুমারি করা হয়, ৫৪২ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন এই গননা করে। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মতে রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যই সেনাবাহিনী এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের আইনটি শুধু মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য। রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে নাগরিক হিসেবে এতদিন গণ্য না করলেও এখন তাদেরকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে।

মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মির প্রভাব এখন বাড়তে শুরু করেছে। আরাকান আর্মির লক্ষ্য হচ্ছে, ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে স্বায়ত্তশাসন অর্জন। ইতিমধ্যে এ এ বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে অতি গুরুত্বপূর্ণ চিন রাজ্যের পালেতোয়া এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে শহরটি বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে অধিকাংশ রোহিঙ্গার বসবাস এবং এ এ’র এই এলাকায় তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে।

এ এ নেতৃত্ব রোহিঙ্গাদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছে এবং তারা রোহিঙ্গাদের শত্রু হিসেবে দেখে না বলেও জানিয়েছে।

মিয়ানমারের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের ভাগ্য নিয়ে সব সময় ছিনিমিনি খেলেছে, যা এখনও চলমান। ১৯৪৮ থেকে ৬২ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার চারটি বহুদলীয় নির্বাচন দেখেছে এবং সেখানে রোহিঙ্গাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল। ১৯৭৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাখাইনে সামরিক অভিযান শুরু করে জান্তা সরকার। তখন তাদের হাত থেকে বাঁচতে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। জান্তা সরকার তাদেরকে মিয়ানমারের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে প্রচার করতে থাকে।

অবৈধ অভিবাসী বলে ১৯৮২ সালে বার্মার নাগরিকত্ব আইন থেকে রোহিঙ্গাদেরকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয় ও তারা রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে।
২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে সংঘর্ষের জন্য কিছু উস্কানিমূলক প্রচারনা ও প্ররোচনা দায়ী।

মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতিগোষ্ঠীগুলোকে বৌদ্ধধর্মের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টায় উইরাথুর মতো সন্ত্রাসী ভিক্ষুর মাধ্যমে ইসলামকে একটি আগ্রাসী ধর্ম হিসাবে চিত্রায়িত করে মিয়ানমারজুড়ে মুসলিম নিধনকে উৎসাহিত করে। এ ছাড়াও রাখাইনের নির্বাচনে রাখাইনদের ভূমিধস বিজয় ঠেকাতে জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করে, যা রাখাইনদের ক্ষুব্ধ করেছিল। ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ প্রান হারায়, লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয় এবং রাখাইনে সহিংসতা বাড়তে থাকে।

সে সময় জাতিসংঘের রাখাইন বিষয়ক অনেক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সংঘাত এড়ানোর চেষ্টায় জাতিসংঘের মিয়ানমার কার্যালয়ের অনেক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রোহিঙ্গার বদলে রাখাইনের মুসলমান বলা হয়। সেই সুযোগে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গার বদলে তাদেরকে বাঙালি বলে আখ্যা দেয় ও তাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করতে থাকে।

কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সু চি সরকারের অনুরোধে সেখানে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার না করে তাদেরকে রাখাইনের মুসলমান হিসেবে দেখানো হয়েছে। দীর্ঘ দুই হাজার বছরের ইতিহাসে রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। তাদের মধ্যে কখনোই জাতিগত বিদ্বেষ ছিল না। তারা পরস্পরের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আরাকানে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। রাখাইন ও মিয়ানমারের রাজনীতিতে ও একসময় রোহিঙ্গাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল, পরবর্তীতে তাদেরকে জোরপূর্বক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তাদেরকে প্রান্তিক জনগুষ্টিতে পরিণত করে নৃশংস নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। তাই বর্তমানে তাদের এই প্রতিশ্রুতি পরবর্তীকালে তারা কতটুকু রাখবে তা ভেবে দেখতে হবে। এর আগে অনেক রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব কার্ড ছিল, সে গুলো তাদের থেকে নিয়ে তাদেরকে আর নতুন কার্ড দেয়া হয়নি ও নাগরিকত্ব বঞ্চিত করা হয়েছিল। যে সংবিধানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে তা বলবত রেখে নাগরিকত্ব দেয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমার জান্তার পক্ষে যোগ দিলে তাদের আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহায়তা পেতে কোন সমস্যা হবে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। কারণ জান্তার উপর আন্তর্জাতিক নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। জান্তা সরকার রাখাইন রাজ্যে জাতিগত উত্তেজনা ছড়াতে রোহিঙ্গাদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করছে বলে অনেকে মনে করে।

অনেকের মতে এ নিয়োগ বেআইনি কারণ গত কয়েক দশক ধরে জান্তা রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করেনি।

এ এ’র বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলে পরবর্তীতে রাখাইনে তাদের অবস্থা কেমন হবে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইনদের সাথেই মিলেমিশে বসবাস করতে হবে। সেনাবাহিনীর এই প্রতিশ্রুতি পড়ে আবার বুমেরাং হয়ে যাতে না যায় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
এতদিন ধরে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগুষ্টিকে নিপীড়নের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখার যে কৌশল সেনাবাহিনী নিয়েছিল তা ব্যর্থ হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিজয়ী অবস্থান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নড়ে গেছে ও বড় ধাক্কা খেয়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্বাভাবিক ভাবেই তাদের নাগরিকদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলতে পারে। রোহিঙ্গাদেরকে সেনাবাহিনীতে যোগদানে বাধ্য করা থেকে বোঝা যায় যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক তবে তাদেরকে নাগরিক অধিকার থেকে জান্তা সরকার পরিকল্পিতভাবে বঞ্চিত করে আসছিল।

একসময় রাখাইনদের মনে যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে তাদেরকে গ্রাম, জনপদ ও বাস্তুভিটা ছাড়তে বাধ্য করেছিল, তাদেরকেই আবার রাখাইনদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে সেই আগের ক্ষোভ উস্কে দেয়া হচ্ছে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ কিংবা সময় ক্ষেপণের জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত নিতে চায় বলে আন্তর্জাতিক মহলকে জানিয়েছে, তবে গত সাত বছরে এর কোন অগ্রগতি দেখা যায়নি।

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে কি করা দরকার তা রোহিঙ্গাদের নিজেদেরকেই ঠিক করতে হবে। মিয়ানমারে তাদের বসবাস, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিকে বিবেচনায় নিয়ে কোনটা ঠিক তা বের করার মত অভিজ্ঞতা রোহিঙ্গাদের রয়েছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো তাদের সেখানে স্বাভাবিক জীবন যাপনের পরিস্থিতি ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে ভুমিকা রাখতে পারে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে আসুক এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়ক পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি হয় সেদিকে সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

  • লেখক : ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন

  • এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল (অবঃ)

  • মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

আরও খবর