তুষার তুহিন :
৩ দিন ধরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত শান্ত রয়েছে। বান্দরবান ও কক্সবাজারের সীমান্তের ওপার থেকে ভেসে আসছে না গোলাগুলির আওয়াজ। সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে আসছে না মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যরা। তবুও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফ সীমান্তের লোকজন আতংকে রয়েছে। দখল হারিয়ে ফেলা সীমান্ত চৌকি উদ্ধারে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর যেকোন মুহুর্তে হামলা চালাতে পারে এমন আশংকা নিয়ে উৎকন্ঠায় দিন পার করছে তাঁরা।
বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, বিজিবি ও সীমান্তবর্তী লোকজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গেল ২ ফেব্রুয়ারী থেকে বান্দরবান ও কক্সবাজারের সীমান্ত ঘেষে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেদেশের সেনাবাহিনী, বিজিপি ও আরকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। ত্রিমুখী সংঘাতে আরকান আর্মির কাছে পরাস্ত হয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমঘুম থেকে টেকনাফের হোয়াইক্যং পর্যন্ত মিয়ানমারের অভ্যন্তরে থাকা প্রায় ডজনখানেক সীমান্ত চৌকি ফেলে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন বিজিপি’র ৩৩০ জন সদস্য।
এখন সীমান্তের সবকটি চৌকি আরকান আর্মির দখলে রয়েছে। আর সেসব চৌকি পুনরুদ্ধার করতে নতুন করে হামলার ছক আকছেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। যেকোন মুহুর্তেই ফের সংঘাত শুরু হতে পারে ওখানে।
এ বিষয়ে ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. খায়রুল বশর বলেন, প্রায়ই প্রতিবছরই মিয়ানমারে গন্ডগোল হয়। তবে এবারের সংঘাতের মাত্রা ভিন্ন। হারিয়ে ফেলা চৌকি উদ্ধারে সেদেশের সেনা যেকোন মুহুর্তে হামলা চালাতে পারে।
ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান একে.এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সীমান্তে গোলাগুলি নাই। তবে লোকজন আতংকে রয়েছে। এর যথেষ্ট কারনও রয়েছে। প্রথমত সীমান্ত ঘেষে থাকা শস্যক্ষেতে অবিস্ফোরিত মর্টারশেল পাওয়া যাচ্ছে। আবার মিয়ানমার বিজিপির চৌকিগুলো বিদ্রোহীরা দখল করে নিয়েছে। আর এগুলো তো পুনুরুদ্ধারের চেষ্টা করবেই সেদেশের সেনাবাহিনী। এনিয়েও শংকা রয়েছে।
এদিকে ঘুমধুমের ১ম//২ক আতংকগ্রস্ত উখিয়ার পালংখালী সীমান্তের লোকজন। এই ইউনিয়নের রহমতের বিল সীমান্ত ঘেষেই মিয়ানমারে চৌকিতে সবচেয়ে বড় সংঘাত হয়েছে। এখান দিয়ে ১৩৭ জন বিজিপি সদস্য সহ মিয়ামারের ২৩ জন উগ্রপন্থী আগ্নেয়াস্ত্র সহ গ্রামে ডুকে পড়ে। এখন পর্যন্ত এই সীমান্ত থেকে ২ টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে একজনের মাথায় হেলমেট ও গায়ে খাকি পোষাক ছিল। এছাড়া মরদেহের শরীরে বুলেট ও ম্যাগজিন বাধা ছিল।
এবিষয়ে পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর গফুর বলেন, সীমান্ত আপাতত শান্ত রয়েছে। তবে ৫ ফেব্রুয়ারী রাত থেকে ৬ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত এই সীমান্তে ব্যাপক সংঘাত হয়েছে। সেদিনের ঘটনার চিহ্ন এখনো সীমান্তে রয়েছে। এছাড়া সেদিনের সংঘাতে বিজিপি তাদের চৌকি ফেলে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। সেই চৌকিটি এখন আরকান আর্মির দখলে রয়েছে। সেটি পুনুরুদ্ধার করতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ফের সংঘাত শুরু করতে পারে বলে তো আশংকা রয়েছে। এজন্য সীমান্তের খুব কাছকাছি লোকজনকে না যেতে মাইকিং করা হয়েছে।
এদিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের মাঝের পাড়া গ্রাম সংলগ্ন সীমান্ত আপাতত শান্ত রয়েছে। সর্বশেষ ১০ ফেব্রুয়ারী এই সীমান্তে গোলাগুলি হয়। আর সেই গুলি এসে পড়ে এপারের ঘর বাড়ি ও দোকানপাটে।
এবিষয়ে ওই ওয়ার্ডের সাইফুদ্দিন নামের এক যুবক বলেন, ওপারের পরিস্থিতি থমথমে। কোন ধরনের সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেষে মিয়ানমারে ফের সংঘাত বাধঁতে পারে এমন আশংকা করে সীমান্ত বিশেষজ্ঞ মেজর ( অব:) এমদাদ হোসেন বলেন, চৌকি উদ্ধারে অবশ্যই মিয়ানমার সেনাবাহিনী আবারো সীমান্তে হামলা চালাবে। এই ক্ষেত্রে তাঁরা কৌশল পরিবর্তন করে চৌকি লক্ষ্য করে দূর থেকে মর্টারশেল, রকেট লঞ্চারসহ ভারী বোমা ছুড়তে পারে অথবা বিমান হামলা চালাতে পারে। তবে এর আগে সেদেশের সরকার কিংবা বিদ্রোহীরা সমঝোতার চেষ্টা করতেও পারে।
কক্সবাজারের ৩৪ বিজিবি‘র অধিনায়ক লে. কর্ণেল আবদুল্লাহ আল মাশরুকি বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি আপাতত শান্ত রয়েছে। তবুও যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনা মোকাবেলা ও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, গতকাল চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার তোফাইল আহমেদ, বাংলাদেশ পুলিশের চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি নূরে আলম মিনা ও বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন সহ কক্সবাজার-বান্দরবানের সীমান্ত এলাকা পরির্দশন করেছি। সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
- অসুস্থ সাবের, ২২ উগ্রপন্থী’র ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর
বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রামে ডুকে পড়া মিয়ানমারের সেই ২৩ উগ্রপন্থীর মধ্যে একজন অসুস্থ থাকায় ২২ জনের ৩ দিন করে রিমান্ড করেছে কক্সবাজারের আদালত।
সোমবার দুপুরে কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট শ্রীজ্ঞান তঞ্চ্যঙ্গা এই আদেশ আদেশ দেন।
আদালত থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গম ৬ ফেব্রুয়ারী (মঙ্গলবার) উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করে রহমতের বিল গ্রামে অনুপ্রবেশ চেষ্টা করে মিযানমারের অস্ত্রধারী কিছু উগ্রপন্থী। তখন তাদেরকে ধাওয়া করে ৪টি আগ্নেয়াস্ত্র ২৩ জনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করে গ্রামবাসী। এরপর থেকে তাঁরা বিজিবির জিম্মায় ছিলেন। পরে ৯ ফেব্রুয়ারী বিজিবির এক সদস্য বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় ১০ ফেব্রয়ারী তাদের আদালতে তুলে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন পুলিশ। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে গতকাল রিমান্ড শুনানী হয়। এতে এজাহার নামীয় ১৮ নম্বর অভিযুক্ত মৃত রশিদ আহমদের ছেলে মো. সাবের অসুস্থ থাকায় তাঁর রিমান্ড না মঞ্জুর করে আদালত। বাকিদের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. শাহাজাহান এলাহী নূরী বলেন, একজন অসুস্থ বিধায় বাকি ২২ জনের তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
উখিয়া থানার ওসি শামীম হোসেন বলেন, আদালতের আদেশের কপি হাতে পেলে অভিযুক্তদের আলাদা আলাদা ভাবে রিমান্ডে আনা হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-