তুষার তুহিন :
# অনিশ্চিতায় ঘুমধুমের এসএসসি পরিক্ষার্থীরা
# সীমান্তে পড়ে থাকা মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ
মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের বুলেট এসে একদিকে কক্সবাজার টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তের ঘরে ঘরে আঘাত হানছে। অন্যদিকে গোলাগুলি কমলেও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে মিলছে একের পর এক অবিস্ফোরিত মর্টারশেল। অপরদিকে উখিয়ার পালংখালীর সীমান্তে পড়ে রয়েছে অজ্ঞাত মরদেহ। সব মিলিয়ে সীমান্তবাসীর ত্রাহিদশা।
কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গেল তিনদিন ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু-ঘুমধুম সীমান্ত ও কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল শান্ত রয়েছে।
তবে গতকাল ভোরে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মাঝেরপাড়া গ্রাম সংলগ্ন সীমান্ত ঘেষে মিয়ামারের অভ্যন্তরে প্রায়ই আড়াই ঘন্টাব্যাপী গোলাগুলি হয়েছে। একই সময়ে তুমব্রুর একটি সবজি ক্ষেতে মিলেছে আরেকটি মর্টারশেল। এমন পরিস্থিতির আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ঘুমধুমের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহন করবেন। তবে এখনো তাদের কেন্দ্র কোথায় হবে তা নিশ্চিত করা হয়নি। অন্যদিকে মিয়ানমারের চলমান যুদ্ধের কারণে টেকনাফ থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সেন্টমার্টিনগামী জাহাজ চলাচল।
ঘরে ঘরে আঘাত হানছে মিয়ানমারের বুলেট :
মিয়ামারের অভ্যন্তরীন ত্রিমুখী সংঘর্ষে এবার অস্থির হয়ে উঠেছে টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্ত। গতকাল সেদেশ থেকে ছোড়া গুলি এসে বাংলাদেশের বাড়িঘর ভেদ করেছে। এতে অল্পের জন্য প্রানে বাঁচে দুটি পরিবার।
শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারী) ভোর ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মাঝের পাড়া গ্রাম সংলগ্ন সীমান্ত ঘেঁষে মিয়ানমারের কুমির খালীতে এ ঘটনা ঘটে।
গ্রামবাসী থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, শনিবার ভোরে মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামে কুমিরখালীতে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। ওইসময় মর্টার শেলের বিকট শব্দে হোয়াইক্যংয়ের এপারের গ্রামগুলো কেঁপে উঠে। একই সময়ে ওপারের গোলাগুলি বুলেট মাঝেরপাড়া গ্রামের হাজী আফসারের জানালা ভেদ করে বসতঘরে পড়ে। আরেকটি বুলেট একই এলাকার মনোয়ারার টিন ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। অল্পের জন্য রক্ষা পায় পরিবার দুটি। এছাড়া অপর একটি মার্কেটেও একটি বুলেট এসে পড়ে।
হোয়াইক্যং ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, ‘ভোরে ওপারে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে। এই সময় আমাদের গ্রামে অনেকগুলো বুলেট এসে পড়ে। এতে কেউ হতাহত না হলেও গ্রামবাসী ভয়ে ও আতংকে রয়েছে।’
বিজিবির একটি সু্ত্র জানিয়েছে, মিয়ানমারের কুমারখালী ও বিলাই চাড় দ্বীপে গোলাগুলি ও ফায়ারিংয়ে ঘটনা ঘটেছে। সেইখানে আরকান আর্মির সাথে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোছন গ্রুপের সাথে গোলাগুলি হয়। নবী হোছন গ্রুপ বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষে আশ্রয় নেওয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
হোয়াইক্যং বিওপির কোম্পানি কমান্ডার আবু বলেন, ‘গোলাগুলির শব্দ ও কয়েকটি বুলেট এপারে এসেছে বলে শুনেছি। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।’
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ওপারের বুলেট এপারের গ্রাসবাসীর ঘর ভেদ করেছে বলে শুনেছি। তবে অন্য একটি জরুরী কাজে টেকনাফে বাইরে থাকায় যেতে পারিনি। কিন্তু সীমান্তের লোকজনকে সতর্ক থাকার জন্য আগে থেকে নির্দেশনা দেয়া রয়েছে।’
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে ঘুমধুম, উখিয়া ও টেকনাফে সীমান্তে বেশ কয়েকদিন ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। প্রথমদিকে টেকনাফ সীমান্ত স্বাভাবিক থাকলেও দু’একদিন ধরে এখানকার সীমান্ত ঘেঁষে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ভোরে কিংবা রাতে গোলাগুলি হয়। শনিবার ভোরে অন্যদিনের চেয়ে বেশি হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রামবাসীকে সতর্ক ও প্রয়োজনে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া রয়েছে।’
তুমব্রুর আতংক মিয়ানমারের ‘মর্টারশেল’
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা ধান ও সবজি ক্ষেতে একের পর এক মিলছে মিয়ানমারের অবিস্ফোরিত মর্টারশেল। গেল তিনদিনে তুমব্রু এলাকা থেকে তিনটি মর্টার শেল উদ্ধার করে বিজিবি। এছাড়া গেল রবিবার এই মর্টারশেলের আঘাতেই রান্না করার সময় এই ইউনিয়নের এক নারীসহ দুইজন নিহত হয়। তাই সীমান্তবাসীর কাছে আতংক হয়ে দাঁড়িয়েছে মিয়ানমারের অবিস্ফোরিত মর্টারশেল।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের কারনণ এক সপ্তাহ পর শনিবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে সবজি ক্ষেতে কাজ করতে যান তুমব্রুর পশ্চিমকুল গ্রামের গৃহবধূ হালিমা বেগম। এসময় তিনি ক্ষেতে একটি মর্টারশেল কুড়িয়ে পান। পরে সেটি তিনি ঘরে নিয়ে যান। তবে এলাকাবাসী এটি ‘অবিস্ফোরিত মর্টারশেল’ জানালে তিনি সেটা তুমব্রু সড়কের ওপর ফেলে যান। সেই থেকে সেটি ওখানে পরে রয়েছে। তবে সড়কটিকে বিপদজনক ঘোষনা দিয়ে লাল পতাকা টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে এবং যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বিজিবি।
শনিবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের ওপর মর্টারশেলটি পড়ে আছে। সড়কের দুপাশে লাল পতাকা পুঁতে দিয়ে বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। পাশ দিয়ে আরেকটি বিকল্প পুরোনো সড়ক রয়েছে। সেটি দিয়ে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ও সিএনজি চালিত অটোরিকশায় চড়ে মানুষ যাতায়াত করছে।
এবিষয়ে তুমব্রুর স্কুল শিক্ষক আবদুর রশিদ বলেন, “হালিমার যে ক্ষেতে শেলটি পাওয়া গেছে, এটি মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ১৫/২০ মিটার দূরে। পাশেই সেদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তুমব্রু রাইট ক্যাম্প।”
পশ্চিমকুলের দোকানদার বাদশা বলেন, “গতকাল একটি, শুক্রবার একটি ও বৃহস্পতিবার আরেকটি মর্টারশেল খোঁজে পায় লোকজন। এলাকায় একের পর এক অবিস্ফোরিত মর্টারশেল পাওয়া যাচ্ছে।”
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, “গত বৃহস্পতিবার থেকে তিনটি অবিস্ফোরিত মর্টারশেল পাওয়া গেছে। এর আগে গত সোমবার জলপাইতলী গ্রামে একটি মর্টারশেল পড়ে দুজন নিহত ও একজন আহত হন। একের পর এক মর্টারশেল পাওয়ায় আতঙ্ক কোনোভাবেই কমছে না।”
সীমান্তে পড়ে থাকা মরদেহ উদ্ধার :
উখিয়ার বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে অজ্ঞাতনামা এক যুবকের মরদেহ পড়ে রয়েছে এমন সংবাদ জানার জানার দুইদিন পর বিজিবি’র সহযোগিতায় মৃতদেহটি উদ্ধার করেছে পুলিশ।
শনিবার বিকেলে উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের থাইংখালীর রহমতের বিল এলাকায় সীমান্ত বিজিবির সহযোগিতায় মরদেহ উদ্ধার করে উখিয়া থানার পুলিশ। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে মরদেহটি দেখতে পায় স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, মঙ্গলবার এই পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১৩৭ সদস্য। তবে সেখানে ২ নারী এবং ২ শিশুও ছিল। সেদিন গোলাগুলিতে উত্তপ্ত ছিল সীমান্ত এলাকাটি। হয়ত সেদিনের গোলাগুলিতে ওই যুবক নিহত হয়। এরপর থেকে ওই এলাকায় চলাচল সীমাবদ্ধ ছিল। পরে বৃহস্পতিবার রাতে এলাকার লোকজন মরদেহটি দেখতে পায়। মরদেহ মিয়ানমারের নাগরিকের বলেও মন্তব্য করেন তাঁরা।
গ্রামবাসী আরো জানিয়েছে, সীমান্তের এদিক সেদিক আরো কয়েকটি মরদেহ দেখা গেছে।
উখিয়া থানার ওসি শামীম হোসেন বলেন, “পুলিশ একজনের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া তাঁর পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে।”
অনিশ্চিতায় ঘুমধুমের এসএসসি পরিক্ষার্থীরা :
আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা শুরু। হাতে সময় আর মাত্র ৪ দিন। কিন্তু গেল বারের মত এবারও বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্র নিয়ে অনিশ্চিতায় আছে।
ঘুমধুমবাসীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সীমান্তবাসীর গেল সপ্তাহ কেটেছে, গোলাগুলি, বোমা , মর্টার শেলের বিকট আওয়াজ আতংকে। গোলাগুলি কিছুটা কমলেও গত তিনদিন ধরে সীমান্তে একের পর এক মিলছে অবিস্ফোরিত মর্টার সেল। এ নিয়ে আতংকগ্রস্ত এসএসসি পরীক্ষার্থীসহ সীমান্তবাসী।
শিক্ষার্থীরা বলছে, গুলির শব্দের কারণে কোনোভাবেই মনোযোগ দেওয়া যায়না লেখাপড়ায়। আতঙ্কে তাঁরা নিজেরাই বাড়িতে থাকতে পারে না, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেও বিদ্যালয়গুলোতে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের সদস্যদেরকে ধুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে, ফলে কোচিং ও ক্লাসও বন্ধ রয়েছে।
তাঁরা আরো জানিয়েছে, নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরিক্ষা অনুষ্ঠিত হতো ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয়। গত বছরও সীমান্তের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় সেবার জরুরী মুহুর্তে এসএসসি পরিক্ষা নেওয়া হয়েছিলো কুতুপালং উচ্চবিদ্যালয়ে।
এ বিষয়ে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেন, “সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্র সরিয়ে নেওয়া হবে। তবে কুতুপালং নয়, অন্য বিদ্যালয়ে কেন্দ্র সরিয়ে নেওয়া হবে।“
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-