আবদুল্লাহ আল মামুন :
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা না থাকার সংবাদে মন খারাপ আওয়ামী লীগের অনেক এমপির। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি সভায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই সংবাদে দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা খুশি হয়েছেন। কিন্তু হতাশ অধিকাংশ দলীয় এমপি। বিশেষ করে গত দুই মেয়াদের আওয়ামী লীগের এমপিরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেন না। এই হতাশা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ঘরোয়া আলোচনায়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছে।
আওয়ামী লীগের এমপিরা মনে করছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলের সব নেতাকর্মীর জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার ফলে তাদের কর্তৃত্ব খর্ব হবে। এর ফলে এমপিদের সহযোগিতা ও উপজেলা কমিটির সুপারিশ নিয়ে দলীয় প্রতীক পাওয়ার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে না চেয়ারম্যান ও মেয়র প্রার্থীদের। নৌকার মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে তারা নিতেও পারবেন না কোনো অর্থ। এর বাইরে স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন এবং সংগঠনে নিজের শক্তিশালী অবস্থান ও প্রভাব ধরে রাখার জন্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকার মনোনয়ন তাদের (স্থানীয় এমপিদের) জন্য বড় একটি অস্ত্র ছিল।
আওয়ামী লীগের টানা দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারের আমলে ২০১৫ সালে নির্দলীয় ব্যবস্থা থেকে দলীয় প্রতীকের যুগে প্রবেশ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। তখন থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে উপজেলা/থানা আওয়ামী লীগের রেজুলেশনের মাধ্যমে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভা নির্বাচনে সম্ভাব্য চেয়ারম্যান ও মেয়র প্রার্থীদের নামের তালিকা পাঠানোর নিয়ম করে দেওয়া হয়। এই তালিকা ও অন্য সব দিক বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড সারা দেশে উপজেলা এবং পৌরসভার নির্বাচনে চেয়ারম্যান এবং মেয়র প্রার্থী চূড়ান্ত করে আসছে।
কিন্তু তৃণমূল থেকে বঞ্চিতরা বরাবরই অভিযোগ করে এসেছেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের রেজুলেশন করার আগে ভোটাভুটির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছেন এমপি অথবা অর্থ বাণিজ্যের কারণে পালটে গেছে রেজুলেশন। সেখানে যার নাম এক নম্বরে থাকার কথা ছিল তাকে রাখা হয়েছে পেছনে। এ ধরনের শত শত অভিযোগ ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে জমা হতে দেখা গেছে। তাদের অধিকাংশই এমপির প্রভাব ও অর্থের কাছে পরাজিত হয়েছেন। আবার ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ সভাপতির অফিসের একটি সিন্ডিকেট তৃণমূল নেতাকর্মীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দলীয় এমপিদের হয়ে কাজ করেছে। এর ফলে যোগ্যরা মনোনয়ন বঞ্চিত হন।
জানা যায়, রাজশাহীর নওহাটা পৌরসভায় মেয়র মনোনয়নে তৃণমূলের এক সভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু ৩৫ ভোট ও হাফিজুর রহমান পান মাত্র এক ভোট। কিন্তু কেন্দ হাফিজুর রহমানকে মনোনয়ন দেয়। স্থানীয় এমপি (একাদশ জাতীয় সংসদ) আয়েন উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ হাফিজুর রহমান এভাবেই হয়ে যান দলীয় প্রার্থী।
কালকিনি পৌরসভার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পান এসএম হানিফ। এ নিয়ে দেখা দেয় বিতর্ক। অভিযোগ আসে মনোনয়ন বাণিজ্যের। দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পরই কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল রানা মিঠু নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলনে দলীয় এই মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, টাকার বিনিময়ে এসএম হানিফ আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে নৌকা কিনে নিয়ে এসেছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে বিব্রত ছিল। ওই সময় এক সভায় মনোনয়ন নিয়ে বাণিজ্য করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, দিনের পর দিন ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্য দলের পদ-পদবি কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, সোমবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি যে সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থিতা নিয়ে তৃণমূলে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়টিও উঠে আসে। সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নৌকা না রাখার সিদ্ধান্ত জানান।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহৃত হবে না এবং দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন সর্বজনীন করার জন্যই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নানক দাবি করেন, এর মাধ্যমে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেওয়ার কারণে মনোনয়ন ঘিরে যে অনিয়ম, তা থাকবে না। ভোটে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়বে এবং নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে।
রাজশাহী-৩ (মোহনপুর-পবা) আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ অবশ্য দলীয় সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছেন। তিনি মনে করেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা না রাখার এই সিদ্ধান্তে সংগঠন (আওয়ামী লীগ) গতিশীল হবে। তৃণমূলে অনেক যোগ্য নেতা নির্বাচিত হয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবেন। প্রথমবারের মতো নির্বাচিত এই সরকারদলীয় এমপি স্বীকার করেন ইতোপূর্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে। এর সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত ছিলেন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-