সকালের সময় :
মাদকের আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি নতুন যুবরাজ হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ বলেন গডফাদার। বর্তমানে তার হাতেই টেকনাফের মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ।
কোস্টগার্ডের সোর্স হিসেবে ক্ষমতা রপ্ত করা এই যুবরাজের ভয়ংকর কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে আসে অনুসন্ধানে। তার নাম মো. মিজান। তিনি টেকনাফ সদর ইউনিয়নের কেরুনতলীর বাসিন্দা।
সম্প্রতি মিজানের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে চোখ আটকে যায়। স্থানীয়রা বলছেন, কোস্টগার্ডের সোর্স পরিচয়ী মিজানই টেকনাফের ইয়াবা জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তার ইশারার বাইরে কিছুই হয় না। সীমান্ত জনপদে মাদক আগ্রাসন বন্ধের জন্য তার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।
জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে নদী পথে আসা ইয়াবা ও আইস পাচার করে অঢেল অর্থ সম্পদের মালিক হওয়া মিজানই এখন সীমান্তের আতংক। এক সময়ের ফিশিং ট্রলারের শ্রমিক এখন বিলাস বহুল রঙ মহলে বসে নিয়ন্ত্রণ করে চোরাচালানের নতুন জগৎ। বর্তমানে তাকে চিনে টেকনাফের মাদক সম্রাজ্যের নতুন যুবরাজ হিসেবে।
এই যুবরাজ গোয়েন্দা সংস্থা ও রাষ্ট্রের কালো তালিকা ভুক্ত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও কোস্টগার্ডের ‘ছত্রছায়ায়’ থেকে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে প্রশাসনিক কার্যালয়সহ সর্বত্র মহড়া দিয়ে নানান অবৈধ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মিজান পাচারকারীর সিন্ডিকেট ছাড়াও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক পরিচয়ী কিছু দুর্বৃত্ত, অসাধু জন প্রতিনিধি, প্রশাসনের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ চক্র ও সোর্স-মিডিয়া কর্মী দিয়ে গড়ে তোলে ৫ স্তরের বাহিনী। এসব বাহিনীর অপশক্তি ব্যবহার করে এবং কোস্টগার্ডের আর্শিবাদপুষ্ট মিজানই মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন বড় বড় মাদকের চালান এনে সারা দেশে সরবরাহ করে রমরমা বাণিজ্য গড়ে তোলেন। কোস্টগার্ডের সোর্স পরিচয়ী এই যুবরাজের আর্শিবাদ না পেলে কেউই মাদক ব্যবসা করতে পারেনা সীমান্ত এলাকায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিজান টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাফ নদীর তীরে কেরুণতলী এলাকার বাসিন্দা। ছোটবেলা থেকেই টেকনাফ কোস্টগার্ডের বোটে কাজ করতেন। মাদকের চালান ধরিয়ে দেয়া, আবার রফাদফা হলে ছাড়িয়ে নেওয়া সবই হয় তার মাধ্যমে। এভাবেই সখ্যতা তৈরী হয় কোস্টগার্ডের কর্মকর্তাদের সাথে। কোস্টগার্ডের সাথে তার ‘উঠা-বসা’ থাকায় একসময় নেমে পড়েন মাদক কারবারে। নাফ নদী থেকে যেকোন মাদকের চালান খালাস করতে তাকে দিতে হয় চাঁদা।
কোস্টগার্ডের সাথে থাকা সখ্যতাকে কাজে লাগিয়ে কয়েক বছরে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক বনে যান মিজান। এভাবে আয় করা কোটি কোটি টাকা খরচ করে ক্রয় করেছেন কার্গো বোট। কিনেছেন কয়েক কোটি টাকায় একাধিক ট্রাক ও মিনিবাস। সেন্টমার্টিনে ৫ কোটি টাকা খরচ করে জমি ক্রয় করে নির্মাণ করেছেন কটেজ। মেরিন ড্রাইভে কয়েক কোটি টাকায় কিনেছেন জমি। নিজ গ্রামে দুই কোটি টাকায় গড়ে তুলেছেন আলিশান দুইটি বাড়ি। ব্যাক্তিগত ব্যাবহারের জন্য ক্রয় করেছেন প্রাইভেট কার। এভাবে নামে-বেনামে অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে তার। অধিকাংশ সম্পত্তি নিয়েছেন তার দুলাভাই ও আত্মীয়ের নামে। কয়েকবছরে তার এমন উত্থানে অবাক এলাকাবাসী।
অভিযোগ রয়েছে, কখনো কখনো আতংক সৃষ্টি করতে কোস্ট গার্ডের সদস্য পরিচয় দিয়ে থাকেন এই যুবরাজ। টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের বিভিন্ন মাদক ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে নিয়মিত নেন মাসোহারাও। বিভিন্ন মাদক ব্যাবসায়ীকে ইয়াবা-আইসসহ নান প্রকার মাদকের চালান কোস্ট গার্ডকে ধরিয়ে দেন। অভিযোগ আছে, জব্দ করা মাদকের চালান থেকে গায়েব করা হয় মাদক। আবার সেগুলো তার সম্বন্ধী সেলিমের মাধ্যে পাচার করা হয় দেশের বিভিন্নস্থানে।
এছাড়াও শুধু মাদক বিক্রি করতে মিজানের রয়েছে একটি বিশাল বাহিনী। যার অন্যতম হলেন, নাইত্তং পাড়ার হাবিব, ইউনুছ, শাকের মাঝি ও সেন্টমার্টিনের কামাল মাঝি, আজিম, জুবায়ের ও মোনাফসহ অন্তত ২০ জনের একটি সিন্ডিকেট। মুলত এদের মধ্যমে কোস্ট গার্ডের ভয় দেখিয়ে মাদক ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে ইয়াবা আত্মসাৎ ও মাসোহারা নেন তিনি।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানান, কোস্টগার্ডের প্রভাব কাটিয়ে সীমান্ত এলাকা থেকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়কে অনেকটা বিনা বাধায় তার মাদকের চালান পাচার করা হয়। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার মাদকের চালান আটক করতে চাইলেও তার নানান কারিশমা, অদৃশ্য অপশক্তি ও নানা প্রভাবে তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। একসময় তার বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগ এনে একটি মামলা করে টেকনাফ থানার তৎকালিন ওসি প্রদীফ। কিন্তু এতেও তাকে দমানো যায় নি। ফলে প্রশাসনের সাথে পেরে উঠা এই যুবরাজের সাহস এখন আকাশ চুম্বী।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কক্সবাজার জেলার অনেক কর্মকর্তারা বিষয়টি ওয়াকিবহাল নন। তবে কোস্টগার্ডের টেকনাফ দপ্তরের সংশ্লিষ্টরা আদৌ এ যুবরাজ কিংবা তার বাহিনীর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় নানা প্রশ্ন দেখা দেয় জনমনে। উল্টো বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তর ও থানা এলাকায় কোস্টগার্ডের কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া, দেন দরবার বেপরোয়া ঘুরাফেরার বিষয়টি আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ডেকে আনবে বলে অভিমত সচেতন মহলের।
এদিকে মাদকের এই যুবরাজ টেকনাফসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে বিলাস বহুল প্রসাদ, ট্রলার, দালান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, নানান মডেলের যানবাহন গড়ার বিষয়টি এখন এলাকায় আলোচ্য বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। সোনারপাড়া এলাকায় আধুনিক প্রসাদ গড়ে তোলার দৃশ্য দেখে ইয়াবা ব্যবসার প্রতি সাধারণ মানুষেরও লোভের সৃষ্টি হচ্ছে বলে অনেকেই ধারণা করেন। যা নিজ ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক।
সূত্র জানায়, এই মাদক যুবরাজের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে টেকনাফের মাদক ব্যবসায়ীরা। তার নেতৃত্বে নাফ নদী সীমান্তের কেরুনতলী, বরইতলী, জাদিমুরা, শাহপরীরদ্বীপ, সেন্টমার্টিনসহ ৫-৬ টি স্পটে মিয়ানমার থেকে প্রকাশ্যে আসছে মাদকের চালান। শুধু ব্যবসাতেই ক্ষান্ত নয় মিজান। এসব স্পটে মিজানের নেতৃত্বে তার অনুসারীরা মাদকের চালান খালাসে চাঁদা আদায় ও সরবরাহ করছে দাপটের সাথে। এতে চরম উৎকন্ঠা ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে স্থানীয়রা।
অভিযোগের বিষয়গুলো অস্বীকার করেছে মিজান বলেন, আমার বিরুদ্ধে যা অভিযোগ আনা হয়েছে তা বাস্তবে এসে দেখে যান। সত্যতা পেলে লিখে দেন
টেকনাফ কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার লেঃ কমান্ডার লুৎলাহিল মাজিদ বলেন, মিজান নামের আমাদের কোন সদস্য বা সোর্স নেই। কেউ যদি কোস্টগার্ডের নাম ব্যাবহার করে অনিয়ম করে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কোস্টগার্ডের চট্টগ্রাম জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. এস এম তাহসিন রহমান বলেন, কোস্টগার্ডের সদস্য বা সোর্স পরিচয়ে মিজানের অপকর্মের বিষয়ে কোন অভিযোগ কেউ এখনো পর্যন্ত করেনি।
আমরা তো বিভিন্ন সময় মিডিয়ায় দেখি পুলিশ, র্যাব, ডিবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয়ে অনেকেই অনিয়ম করে বেড়ায়। আবার অনেকেই প্রশাসনের হাতে গ্রেফতার হয়। মিজান নামের কোন ব্যাক্তি যদি কোস্ট পরিচয় ব্যাবহার করে অপকর্ম করে থাকে তদন্ত করে ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-