কক্সবাজারে ৪টি সংসদীয় আসনের ৯০ শতাংশ কেন্দ্রই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’

বিশেষ প্রতিবেদক :

পর্যটন জেলা কক্সবাজারে এখন নিস্থব্ধ পরিবেশ। সব কিছু স্বাভাবিক। তবে, থেমে গেছে মাইকের আওয়াজ। বন্ধ হয়েছে প্রচার-প্রচারণা। আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারের ৪টি সংসদীয় আসনের প্রতিটি উপজেলার গুরুত্বপূর্ন যে সকল এলাকায় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় ছিল মুখর, তা এখন নিস্থব্ধ।

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী ভোটের-৪৮ ঘণ্টা আগেই শেষ হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা।

(৫ জানুয়ারি) সকাল ৮টার পর থেকে জেলার ৪টি সংসদীয় আসনে কোন প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণা লক্ষ করা যায়নি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিগত ১৮ ডিসেম্বর প্রতিক পাওয়ার পর থেকে উত্তপ্ত ছিল নির্বাচনী মাঠ। তবে শেষ সময়ে চলছে হিসাব নিকেশ।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আগামী রবিবার ৭ জানুয়ারী সারা দেশের ন্যায় কক্সবাজারের ৪টি সংসদীয় আসনে অনুষ্ঠিত হবে ভোট উৎসব। ভোট উৎসবের জন্য স্থানীয় প্রশাসন তৎপর রয়েছে।

কক্সবাজার জেলার মোট চারটি সংসদীয় আসনে মোট ভোটার ১৬ লক্ষ ৫০ হাজার ৯৬০ জন। তারমধ্যে পুরুষ ৮ লক্ষ ৭৩ হাজার ৪৮০ জন এবং নারী ভোটার হচ্ছে ৭ লক্ষ ৭৭ হাজার ৪৭৮ জন। কক্সবাজার জেলায় তৃতীয় লিঙ্গ অর্থাৎ হিজড়া ভোট রয়েছেন ২ জন। চারটি আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটার হচ্ছে কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও ও রামু উপজেলা নিয়ে গঠিত কক্সবাজার-৩ আসনটি। এ আসনে ভোটার ৪ লক্ষ ৮৯ হাজার ৬১০ জন। সবচেয়ে কম ভোটারের আসন হচ্ছে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা নিয়ে গঠিত কক্সবাজার-৪। এ আসনে ভোটার ৩ লক্ষ ২৬ হাজার ৯৭১ জন।

আর জেলার ৪টি সংসদীয় আসনে মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৫৫৬। কেন্দ্রগুলোতে কক্ষ আছে ৩ হাজার ৩০৭টি। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ ভোটকেন্দ্রকেই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বা অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

বিশেষ করে সাগরদ্বীপ মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত কক্সবাজার-২ আসনে শতভাগ কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাছাড়া কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে ৯৮ শতাংশ, কক্সবাজার-৩ আসনের রামু ও ঈদগাঁও উপজেলার ৯০ শতাংশ ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

জানা যায়,বিগত ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনী সহিংসতায় কক্সবাজার-১ আসনের পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের মাতবরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থক মো. আবদুল্লাহ (২২) নিহত হয়েছিলেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও এই কেন্দ্রে গোলযোগ ও সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন ভোটাররা।

এবার নৌকার প্রার্থী না থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বাংলাদেশ কল্যান পার্টির প্রার্থী (সভাপতি) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের হাতঘড়ি প্রতীকের পক্ষে মাঠে বিভাগ নেমেছেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলমও ট্রাক প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। পেকুয়া উপজেলায় ভোটকেন্দ্র রয়েছে ৪৪টি।

এর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ২২টি, ঝুঁকিপূর্ণ ২২টি। পেকুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, সব কটি ভোটকেন্দ্রকে প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ নজরে রেখেছে। চকরিয়া উপজেলায় ভোটকেন্দ্র আছে ১১৪টি।

এর মধ্যে ৯৬টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৮টিকে জনের ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চকরিয়া লাস থানার ওসি শেষ মোহাম্মদ আলী ৫৫ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে অধিক গুল নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে।

কক্সবাজার-১ আসনে মোট ভোটকেন্দ্র ১৫৮টি। ভোটার ৪ লাখ ৮৬ হাজার ২৫২ জন। ২০২১ সালের লাটি ২০ সেপ্টেম্বর ইউপি নির্বাচনে কক্সবাজার-২ একে আসনের মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নের জামেউল সুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে দুই পক্ষের উড সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে নিহত হন আবুল কালাম।

এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আশেক সে উল্লাহ রফিকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিএনএম প্রার্থী ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শরীফ বাদশা। এবারও ভোটকেন্দ্রটিতে গোলযোগের আশঙ্কায় আছেন ভোটাররা। কেন্দ্রটিতে ভোটারসংখ্যা ৪ হাজার ৬৯৪।

কক্সবাজার-২ আসনের (মহেশখালী ও কুতুবদিয়া) মহেশখালীতে ভোটকেন্দ্র রয়েছে ৮১টি। সব কটি কেন্দ্র অধিক গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে মহেশখালী থানার ওসি সুকান্ত চক্রবর্তী বলেন, দুর্গম ও দ্বীপ এলাকায় সব কটি ভোটকেন্দ্র, তাই কঠোর নিরাপত্তা গ্রহণ করা হচ্ছে।

অন্যদিকে কুতুবদিয়া উপজেলার ৩৭টি কেন্দ্রের সব কটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ জানতে চাইলে কুতুবদিয়া থানার ওসি গোলাম কবির বলেন, এখানে সাধারণ কেন্দ্র নেই বললেই চলে। অধিকাংশ কেন্দ্র দুর্গম এলাকায় হওয়ায় হেঁটে যেতে হয়। তারপরও সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে ।

কক্সবাজার-৩ আসনে (সদর, রামু ও ঈদগাঁও) মোট ভোটকেন্দ্র ১৬৭টি। এর মধ্যে রামুতে ৬৪টি,কক্সবাজার সদরে ৭৬টি ও ঈদগাঁওয়ে ৩৬টি। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ ভোটকেন্দ্রকেই ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়েছে।

কক্সবাজার সদরের ৭৬টি ভোটকেন্দ্রের সব কটি ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করার কারণ জানিয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি মো. রাকিবুজ্জামান বলেন, এ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচনী প্রচারণা চললেও যেকোনো মুহূর্তে গোলযোগ দেখা দিতে পারে। এই আসনে ভোটারসংখ্যা ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৬১০ কক্সবাজার-৪ আসনে (উখিয়া, টেকনাফ) ভোটকেন্দ্র রয়েছে ১০৪টি।

এর মধ্যে টেকনাফে ৫৭টি এবং উখিয়াতে ৪৭টি। টেকনাফে ১৪টিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৩৪টি কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ দাবি করে টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো. ওসমান গণী বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রসমূহে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রস্তুতি চলছে। উখিয়ার ৪৭টি কেন্দ্রের ৯০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৬ হাজার ৯৭১ জন।

চকরিয়া পৌরসভার সংখ্যালঘু ভোটার বাবুল দে ও উদ্ন্দ্রিরা দে বলেন, ট্রাক ও হাতঘড়ি প্রতীকের পক্ষে ভোট চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না তাঁরা। কেন্দ্র দখল নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যেতে পারে। কারণ, দুই পক্ষেই আওয়ামী লীগের লোকজন। একই কথা বলেন কক্সবাজার পৌরসভার ভোটার শ্যামল কান্তি দে ও রেখা রানী। তাঁরা বলেন, নিরাপত্তা না পেলে তাঁরা কেন্দ্রেই যাবেন না।

এদিকে মাঠের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সর্বোপরি সাধারণ ভোটারদের সাথে মতবিনিময় করে কারা কারা বিজয়ী হতে পারেন তার একটি আভাস- ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।তবে এ কথাটি জোর দিয়ে বলা যায় যে, জেলায় চারটি আসনে নিস্তেজ, নিরুত্তাপ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও একপেশে নির্বাচনী মাঠকে বেশ জমিয়ে দিয়েছেন চারজন প্রার্থী।

তারা হলেন কক্সবাজার-১ আসনে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল, বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, কক্সবাজার-২ আসনে এই সদ্য পদত্যাগকারী মহেশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শরীফ বাদশাহ, কক্সবাজার-৩ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত, স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিষ্টার মিজান সাঈদ ও কক্সবাজার-৪ আসনে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল বশর।

চারটি আসনের সাধারণ ভোটার এবং রাজনৈতিক সচেতন মহলের চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে ইবরাহিম, শরীফ বাদশাহ, মিজান সাঈদ ও নুরুল বশর নির্বাচনী মাঠে সরব না থাকলে বর্তমান চার সংসদ সদস্যই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যেতেন। এ চারজনের কোনোরকম প্রচারণাই চালাতে হতো না। কারণ অন্য যে সকল প্রার্থী আছেন তারা সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল।

তবে সাধারণ ভোটাররা জানান, অবাদ,সুষ্ঠ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে যেই নির্বাচিত হবেন, তিনি যে সাধারণ মানুষের পক্ষে সংসদে কথা বলেন। নির্বাচন এলে অনেক অপরিচিত মুখ দেখা যায় যাদের কস্টের দিনে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন প্রাকৃতি দূর্যোকে দেখা যায়নি এমন অনেকেই প্রার্থী হয়েছেন। তবে, সব সময় যাকে সুখে দুখে কাছে পাওয়া যায় তাকেই বিজয়ী করতে তবে।

কক্সবাজারের ৪টি সংসদীয় আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন করতে যা করা প্রয়োজন, আমরা তার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই কিংবা গোলযোগের সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না।

আরও খবর