কক্সবাজারে ক্রীড়ার আড়ালে ইয়াবা ব্যবসায় কোটিপতি শাহজাহান আনসারী

জসিম উদ্দিন, যুগান্তর:

শাহজাহান আনসারী (৪০)। ভাগ্যান্বেষণে ১৯৯৮ সালে চকরিয়ার হারবাং থেকে সপরিবারে চলে আসেন কক্সবাজার শহরে। আশ্রয় নেন হাশেমিয়া মাদ্রাসাসংলগ্ন একটি ভাড়া বাসায়। তার বাবা মোহাম্মদ আনসারী ছিলেন সামান্য একজন মুদি দোকানি। অভাব নিত্যসঙ্গী হওয়ায় লেখাপড়ায় বেশিদূর যেতে পারেনি শাহজাহান। তবে খ্যাতি অর্জন করেন ভালো ফুটবলার হিসাবে। ফুটবল খেলে পথ চলতে চলতে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পাওয়ার মতো অবস্থা হয় তার। অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান। কাগজে-কলমে হোটেল এবং পরিবহণ ব্যবসার পাশাপাশি এলাকায় ক্রীড়াঙ্গন নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে খ্যাতি কুড়িয়ে নেন।

মনে হতে পারে জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করে উঠে আসা কোনো এক শিল্পপতির গল্প। বাস্তবতা হলো, গল্পটি মূলত আত্মস্বীকৃত ইয়াবা গডফাদার শাহজাহান আনসারীর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি সে। দুই হাতে টাকা উড়ানোর কারণে তার ঘনিষ্ঠজন হয়ে ওঠেন জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা।

মূলত ইয়াবা কারবার করে অঢেল সম্পদের মালিক হন শাহজাহান। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করায় দুই মামলায় ইতোমধ্যে আসামি হয়েছেন তিনি ও তার স্ত্রী জিগারুননেছা জিনিয়ার। এই দম্পতির নামে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বাদী হয়ে সোমবার নিজ কার্যালয়ে এ মামলা করেন।

শাহজাহান আনসারী ২০১৯ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি ইয়াবা কারবারি হিসাবে আত্মসমর্পণকারীদের একজন। এর আগে তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইনে এজাহার দায়েরের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মামলার পর এজাহারকারী কর্মকর্তা বাদে অন্য কর্মকর্তাকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে এজাহারের কপি, তদন্তকারী ও তদারককারী কর্মকর্তা নিয়োগের পত্র পাঠানোর জন্য কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালককে নির্দেশ দেয় কমিশন।

এজাহারে বলা হয়, দুদকের অনুসন্ধানকালে সংগৃহীত নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শাহজাহানের মোট সম্পদ ৩ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৭ টাকা। এর মধ্যে জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ৯৪ লাখ ১২ হাজার ৪৮০ টাকা। পাশাপাশি স্ত্রী জিগারুননেছার মোট সম্পদ ৮৮ লাখ ১০ হাজার ৮৯০ টাকা। এর মধ্যে জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ ৮৫ লাখ ১৫ হাজার ৬২৫ টাকার। মামলা হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন দুদক কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন।

তিনি জানান, শাহজাহান ও তার স্ত্রী জিগারুননেছার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শাহজাহানকে উভয় মামলায় আসামি করা হলেও তার স্ত্রীকে একটিতে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ২০১৯ সালে টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের হাতে আত্মসমর্পণ করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ও আত্মস্বীকৃত ১০২ ইয়াবা কারবারি। তাদের অন্যতম শাহজাহান আনসারী। এরপরই শাহজাহান ও তার পারিবারিক সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ করেছিলেন ইয়াবা সম্রাট শাহজাহান আনসারী। কালের আবর্তে পরিস্থিতি বদলে গেলে ফের জামিনে বের হয়ে আসে। বন্দুকযুদ্ধে নিহত দেশের শীর্ষ ইয়াবা মাফিয়া হাজি সাইফুলের ডানহাতখ্যাত শাহজাহান আনসারী পূর্বেকার সব ইয়াবা ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ পুনরুদ্ধার করে নতুন করে নবোদ্যমে সারা দেশে সরবরাহ করে যাচ্ছে ইয়াবা। নিজেকে ব্যবসায়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে জোরপূর্বক হোটল দখলে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

আরও জানা যায়, ফুটবলার ও পরিবহণ কর্মচারী হিসাবে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জীবিকা নির্বাহ করে এলেও ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে শাহজাহান আনসারী ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে মাদক পাচারকারী সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। এরপর থেকে তাকে পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। কয়েকজনের এই সিন্ডিকেটের প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসাবে কাজ করতেন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া দেশের শীর্ষ ইয়াবা মাফিয়া হাজি সাইফুল করিম। সহযোগী ছিলেন শাহজাহান আনসারীর ছোট ভাই আবু সুফিয়ান আনসারী। সিন্ডিকেটে ছিল সাবেক পুলিশ সদস্য, আইনজীবী, স্থানীয় গ্রাম ডাক্তার ও বিকাশ দোকানদারসহ আরও অনেকে।

জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর শাহজাহানের বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। কিন্তু টের পেয়ে আগেই পালিয়ে যাওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। ক্রীড়ামোদীদের অভিযোগ, এক সময় ইয়াবা গডফাদার শাহজাহান আনসারীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল কক্সবাজারের ফুটবল অঙ্গন। তখন তার কথাই যেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার আইন ছিল।

সরকারের পাঁচটি সংস্থার সমন্বয়ে তৈরি করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় জেলার ইয়াবা ডন হিসাবে যাদের নাম উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যে শাহজাহান আনসারী অন্যতম। সামান্য পরিবহণ কর্মচারী থেকে ইয়াবা ব্যবসা করে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া আনসারীর কব্জায় ছিল জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। তবে আত্মসমর্পণের পর তার প্রভাবে ভাটা পড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে শাহজাহান আনসারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেননি। তবে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন তিনি।

আরও খবর