আশ্রয় শিবিরে এবার রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ঘরভাড়া আদায়!

আবদূর রহমান, টেকনাফ :

বর্গফুট হিসেবে ফ্ল্যাট কেনাবেচা হয়। মার্কেটও ভাড়া হয় একই নিয়মে। এমন অনেক কিছুই হয় বর্গফুটের হিসাবে। এবার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে মাটির ঝুপড়িঘর ভাড়া দেওয়া হচ্ছে বর্গফুটের বদলে হাতে মেপে!

এটা ঘটছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার চারটি শরণার্থী শিবিরের ২০ হাজারের বেশি পরিবারের ক্ষেত্রে। তাদের কাছ থেকে ৭০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ঘরের জমি হাতে মেপে। এসব জমির মালিকানা দাবি করে ভাড়া আদায় করছে স্থানীয় কিছু প্রতারক। আর এই ঘরভাড়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ত্রাণসামগ্রীও বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন রোহিঙ্গারা।

সম্প্রতি টেকনাফের চারটি রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। যদিও সরকারি হিসাবে ১২ হাজার ১৬৪ দশমিক ২ একর বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরগুলো গড়ে উঠেছে। এর মধ্য ৬ হাজার একর জমিতে টেকনাফে গড়ে উঠেছে চারটি ক্যাম্প। এখন প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি জমিতে গড়ে ওঠা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ভাড়া দিতে হচ্ছে কেন?

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুড়া, লেদা, নয়াপাড়া ও আলীখালী এলাকায় চারটি ক্যাম্প রয়েছে। অধিকাংশ ক্যাম্প পাহাড় ও বনের জমিতে। এর মধ্য ২৪ নম্বর ক্যাম্পে ৫ হাজার ৬৫৮ পরিবারের ২৬ হাজার ৪৭০ জন, ২৫ নম্বর ক্যাম্পে ২ হাজার ৩১১ পরিবারের ১০ হাজার, ২৬ নম্বর ক্যাম্পে ৯ হাজার ৪২৮ পরিবারের ৪২ হাজার ৬০০ জন, ২৭ নম্বর ক্যাম্পে ৪ হাজার ২০০ রোহিঙ্গা পরিবারের ২০ হাজার বসবাসকারী রয়েছে। সব মিলিয়ে এই চারটি ক্যাম্পে ২০ হাজারের বেশি পরিবারের এক লাখ মানুষের বসতি।

রোহিঙ্গা নেতাদের ভাষ্যমতে, এদের মধ্য ২ হাজার ৯০০ পরিবারের সাড়ে ১৪ হাজার রোহিঙ্গা ছাড়া বাকি সবাইকে ঘরভাড়া গুনতে হচ্ছে। ১৭ হাজার পরিবারের ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে টাকা খরচ করে থাকতে হচ্ছে ক্যাম্পে। প্রতি পরিবার মাসে ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির এক সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা আসতে থাকে। নিবন্ধিত মোট ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের বনভূমিতে বসতি স্থাপন করেছে। এ সংখ্যা গত ছয় বছরে ১৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। পুরোনো দুটি নিবন্ধিতসহ রোহিঙ্গাদের মোট ক্যাম্প ৩২টি।

সরেজমিন দেখা যায়, টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে নতুন-পুরোনো মিলে ৫ হাজার ৭১৪ পরিবারের প্রায় ২৯ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার বসতি। এদের মধ্য ৩৭শ’ পরিবারের প্রায় ১৯ হাজার মানুষের ঘরের ফুট মেপে ভাড়া দিতে হচ্ছে। যার একটি অংশ পাহাড়ের পাদদেশে। প্রতিটি ঘরের মাসিক ভাড়া ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা দিতে হচ্ছে। আর এসব ঘরের জমি নিজেদের বলে দাবি করছে স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ শুক্কুর, মোহাম্মদ হোসেন, মোহাম্মদ ওসমান ও মোহাম্মদ মাউছন।

এ বিষয়ে টেকনাফ লেদা ক্যাম্পের জমির মালিক দাবিদার ওসমান বলেন, ‘আমাদের চার ভাইয়ের ১০০ ঘর রোহিঙ্গাদের ভাড়া দিয়েছি। এই জমিগুলো আমাদের বাপ-দাদার আমলের, লিজ হিসেবে নিয়ে এই জমিগুলো ভোগ দখল করতো তারা। এখন আমরা সেগুলো ভাড়া দিয়েছি।’ কিন্তু লিজের জমি ভাড়া দেওয়ার নিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের প্রতিনিধি টেকনাফের ২৪ ও ২৫ নম্বর ক্যাম্প ইনচার্জ (সিনিয়র সহকারী সচিব) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে বন বিভাগের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো কোনও জায়গায় গড়ে উঠেছে, সেটি আমাদের বুঝিয়ে দেয়নি। এতে আমাদেরও একটু হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে ক্যাম্প থেকে ঘরভাড়া নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।’

এক বছর আগে স্বামীর রেখে যাওয়া তিন শিশু সন্তান নিয়ে টেকনাফের লেদা বি-ব্লকে বসবাস করছেন জাহেদা বেগম (৩৬)। খুব কষ্টে জীবনযাপন করছেন উল্লেখ করে জাহেদা বলেন, ‘আমরা বাঁচি আর মরি, মাস শেষে ঘর ভাড়া দিতে হয়। না হলে এখানে এসে হুমকি-ধমকি দেয়। আমরা ক্যাম্পের ভেতরে পাহাড়ের কাছাকাছি থাকলেও প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে ঝুপড়িঘরের (মাটি) ভাড়া দিতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এমনিতে স্থানীয় মানুষের ঘরে ঘরে মজুরি করে ছেলেমেয়েদের চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি। এতে ঘরভাড়া দেওয়া খুব কঠিন। তার ওপরে রেশন কমিয়ে দেওয়ায় আরেক মহাবিপদে। কারণ, আগে কিছু রেশন বিক্রি করে ঘরভাড়া জোগাড় করতাম। এখন আর সেই সুযোগ হচ্ছে না। কেননা, এখন যে রেশন পাই সেগুলো দিয়ে ঠিকমতো সংসার চালানো খুব কঠিন।’

হতাশা প্রকাশ করে লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের মাঝি আবু হোসেন বলেন, ‘১০ থেকে ১২ ফুট ঘরে ৫০০ টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে। আমার ব্লকে ২০০ ঘর ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছে রোহিঙ্গারা। আমরা যে ত্রাণ খাবারের জন্য পাচ্ছি, তা নিয়ে আমাদের চলা খুব কষ্টকর। কিন্তু এর মধ্যও ত্রাণ বিক্রির টাকায় ঘর ভাড়া পরিশোধ করতে হয় প্রতি মাসে। শিবিরগুলোতে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এমনিতেই অনেক কষ্ট। তার ওপরে ঘর ভাড়া নিয়ে সবাই খুব চিন্তিত। রেশন কমে যাওয়ায় ত্রাণ বিক্রি করে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা জোগাড় করা সহজ কথা নয়। আবার অনেকে ঘরভাড়া জোগাড় করতে বাইরে মজুরি খাটছে। যার ঝুপড়িঘর যত বড় ভাড়াও তত বেশি। কারণ, এখানে মাটি মেপে ঘরভাড়া দিতে হচ্ছে আমাদের।’

টেকনাফের জাদিমুড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মো. জাফর আলম বলেন, ‘আমরা ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের চারটি ক্যাম্প রয়েছে সীমান্তের টেকনাফে। এখানে ২০ হাজার পরিবারের প্রায় এক লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ক্যাম্পে আমাদের প্রায় ৮০ হাজারের বেশি মানুষের প্রতি মাসে ঘরভাড়া দিতে হচ্ছে। এতে রোহিঙ্গারা খুব চিন্তিত। কেননা, রেশন কমিয়ে দেওয়ায় আমরা হিমশিম খাচ্ছি। মানবিক বিবেচনায় যাতে ক্যাম্পে এসব রোহিঙ্গাদের ঘরভাড়া দিতে না হয় সেজন্য সরকারের হস্তক্ষেপ খুব দরকার।’

নুরালী এলাকায় গড়ে উঠেছে একটি অস্থায়ী রোহিঙ্গা শিবির। সেখানে চার হাজার রোহিঙ্গার জন্য ১১৫টি ঝুপড়িঘর রয়েছে। তাদেরও প্রতিটি ঘরের মাসিক ৫০০-১০০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়।

এদিকে আশ্রয় শিবিরগুলো সরেজমিন ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশ্রয় শিবিরের এসব জমি মূলত বন বিভাগের। রোহিঙ্গারা আসার পর এসব জমিতেই আশ্রয় শিবির গড়ে ওঠে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লেদার এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে আমরা তাদের বনের জমিতে বসবাস করে আসছি বলে আসলেও ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে এখানে ঘরভাড়া দিতে হচ্ছে। দুই দফা রেশন কমিয়ে দেওয়ায় এই দুর্দিনের মাঝে ৫০০-১০০০ হাজার ঘরভাড়া দিতে বাধ্য রোহিঙ্গারা। অন্যথায় তাদের ঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু উখিয়ায় কোনও রোহিঙ্গাকে ঘরভাড়া দিতে হয় না। যার কারণে অনেকে টেকনাফ থেকে উখিয়া ক্যাম্পে চলে গেছে।’

টেকনাফের আলীখালী ক্যাম্পের বসবাসকারী রহিমা খাতুন পরিবার নিয়ে উখিয়া বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘টেকনাফের ক্যাম্পে ঘরভাড়া দিতে হয়। ফলে আমাদের খুব কষ্ট হতো। আর ভাড়া দিতে না পারলে লোকজন এসে ঘর থেকে বের করে দিতেন। আমাদের সঙ্গে কয়েক দফায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তাই একেবারেই উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে চলে এসেছি। এখানে ক্যাম্পের ঘরগুলোর ভাড়া দিতে হয় না।’

জানতে চাইলে কক্সবাজারের টেকনাফের বন বিভাগের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘মানবিক চিন্তা থেকে সরকার টেকনাফে বনের ৬ হাজার একর জমিতে চারটি শরণার্থী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। এখানে কোনও ব্যক্তিগত মালিকানার জমি নেই। যার ফলে কারও মাটি বা ঘরভাড়া নেওয়ার সুযোগ নেই। যদি কেউ এদের কাছ থেকে ঘরভাড়া নিয়ে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) সামছু দৌজা বলেন, ‘আসলে জমির বিষয়টি বন বিভাগের দায়িত্ব। তবু আমরা এই ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখবো।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) মহাসচিব জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘মূলত রোহিঙ্গারা রেশন নিয়ে চলে। তার মধ্য ঘরের ভাড়া দেওয়া তাদের জন্য খুব কঠিন। যেহেতু রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সরকারি জমিতে গড়ে উঠেছে, ফলে যারা আইন অমান্য করে ভাড়া আদায় করছে, সেটি তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার সরকারের।’

আরও খবর