সনাতনী পদ্ধতিতে ইয়াবা খুঁজবে রেলওয়ে পুলিশ

এস এম রানা, চট্টগ্রাম (প্রবা)

মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে সর্বনাশা মাদক ইয়াবা ও আইসের চালান আসে বানের স্রোতের মতো। মাদক পাচার ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি, জলপথে কোস্ট গার্ড এবং স্থলভাগে পুলিশ-র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযান চলে প্রতিনিয়ত।

তবুও সীমান্ত দিয়ে মাদক পাচার ঠেকানো যেন রীতিমতো দুঃসাধ্য এমন বাস্তবতায় পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার আয়োজন না করেই ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ চালু হচ্ছে। কক্সবাজারে নবনির্মিত আইকনিক রেলস্টেশনে যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশির প্রয়োজনে বিমানবন্দরের মতো লাগেজ স্ক্যানার বা আর্চওয়েও বসানো হয়নি। অথচ দৃষ্টিনন্দন এই রেলওয়ে স্টেশনে রাখা হয়েছে বাকি সব সুযোগ-সুবিধা।

ট্রেন কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সরাসরি ঢাকা যাবে। যাত্রীদের কেউ মাদক পরিবহন করলে সেই যাত্রী নির্বিঘ্নে ঢাকা গিয়ে পৌঁছবেন এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ভালোভাবেই বোঝেন। কিন্তু আইকনিক রেলস্টেশনের নির্মাণ পর্যায়ে মাদক পাচার রোধের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি বলেই লাগেজ স্ক্যানার এবং আর্চওয়ে বসানো হয়নি এমনটি মনে করেন চট্টগ্রামের এক পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকারের বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়ে পুলিশের মতামত নেওয়া হয় না। মেগা প্রকল্পের কাজ শেষে নিয়ম অনুযায়ী নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। কিন্তু গোড়াতেই যদি গলদ থাকে, তাহলে শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এখন নতুন রেলসড়কের অবস্থাও হয়েছে তেমন। অথচ মাদক পাচার রোধে রেলস্টেশনগুলোতে কী ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা জরুরিÑ সেই বিষয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশ, চট্টগ্রামের রেলওয়ে পুলিশ কিংবা চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের কারও মতামত নেওয়া হয়েছিল বলে আমার জানা নেই।’

যেহেতু স্ক্যানার বা আর্চওয়ের মতো বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তাই বলা যায় এ পথে ইয়াবা ও আইসের মতো ভয়ংকর মাদক খুঁজতে হবে তল্লাশির মতো সনাতনী পদ্ধতিতে।

গত ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার এই মেগা প্রকল্প উদ্বোধন করেন। ওইদিন তিনি কক্সবাজার থেকে রেলপথটি উদ্বোধন করে নতুন রেলযোগে রামু স্টেশন পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। এরপর তিনি কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গিয়ে জনসভা করেন।

প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করার পর ১ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে রেল চলাচলের সিদ্ধান্ত জানায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সেই ধারাবাহিকতায় অনলাইনে টিকিট বিক্রিও করে রেল কর্তৃপক্ষ। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী শুক্রবার ভোরে যাত্রীবাহী রেল পৌঁছবে সমুদ্রসৈকতের শহরে। এর মধ্য দিয়ে কক্সবাজারের সঙ্গে সারা দেশের রেলপথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ শুরু হবে।

এমন শুভক্ষণে যখন কক্সবাজার ও চট্টগ্রামসহ সারা দেশের মানুষ উৎফুল্লিত, তখনই মাদক পাচার রোধের বিষয়টি পুলিশকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। এই পথে যদি পাচারকারীরা ইয়াবা পাচার শুরু করে, তাহলে পুলিশের জন্য সেটি কঠিন হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ প্রতিটি রেলে সাত থেকে আট শতাধিক যাত্রী থাকবে। বিপুল সংখ্যক যাত্রীর ব্যাগ তল্লাশি করার সুযোগ বাস্তবিক অর্থে সীমিত। আবার সন্দেহভাজন ধরে তল্লাশি করতে গেলেও পুলিশের বিরুদ্ধে পর্যটক হয়রানির অভিযোগ উঠতে পারে। সেই সঙ্গে কোনো পর্যটক যদি অহেতুক হয়রানির শিকার হন, তাহলে কক্সবাজার এক্সপ্রেস পরবর্তীতে পর্যটক-অবান্ধব রেলে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় পুলিশকে এখন মাদক পাচার রোধেই বেশি নজর রাখতে হচ্ছে। যাতে পর্যটকের ছদ্মাবরণে মাদক পাচারকারীরা নির্বিঘ্নে ইয়াবা-আইস পরিবহন করতে না পারে।

ইয়াবা-আইসের প্রবেশদ্বারখ্যাত কক্সবাজার জেলা থেকে ১ ডিসেম্বর বাণিজ্যিক রেল যোগাযোগ শুরু হচ্ছে; এ অবস্থায় মাদক পাচার কীভাবে ঠেকাবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পুলিশ সুপার প্রকৌশলী মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘১ ডিসেম্বর থেকে রেল বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু করতে যাচ্ছে। সেই লক্ষ্যে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল সার্বিক প্রস্তুতি শেষ করেছে। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কক্সবাজার এক্সপ্রেসে থাকবেন ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের সদস্যরা।

চট্টগ্রাম পৌঁছে ঢাকা অঞ্চলের পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের সদস্যদের কাছে। এরপর চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের সদস্যরা নিরাপত্তা দিয়ে রেল নিয়ে যাবেন কক্সবাজার। আবার ফিরতি পথে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আসবেন পূর্বাঞ্চলের রেলওয়ে পুলিশ। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী যাত্রায় থাকবে ঢাকা রেলওয়ে পুলিশ। এভাবে রেলযাত্রীদের নিরাপত্তায় পুলিশ কাজ করবে।’

ইয়াবা-আইস পাচার রোধে এরই মধ্যে রেলওয়ে পুলিশ কাজ শুরু করেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের অগ্রবর্তী টিম এখন কক্সবাজার অবস্থান করছে। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম চলছে। রেলস্টেশনে সন্দেহভাজন কোনো যাত্রী দেখলে তার ব্যাগ তল্লাশি বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ছাড়া প্রয়োজনে রেলওয়ে পুলিশ সন্দেহভাজন যাত্রীর ব্যাগ তল্লাশি করবে।’

মাদক পাচারের ক্ষেত্রে রেলওয়ে জিরো ট্রলারেন্স-নীতি ঘোষণা করে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মাদক পাচারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নজরদারির নির্দেশ দিয়েছে। সেই মোতাবেক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদস্যরা নতুন এই রেলপথে যাত্রীসেবা দেবে।’

অনুমোদন পায়নি পুলিশের জনবল

দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার নতুন এই রেলপথের নিরাপত্তায় রেলওয়ে পুলিশের ছয়টি ফাঁড়ি, দুটি থানা এবং একটি সার্কেল স্থাপন এবং দুই শতাধিক জনবলের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রস্তাব এখনও অনুমোদন পায়নি বলে জানা গেছে। অবশ্য রেলওয়ে পুলিশের জন্য ফাঁড়ি, থানা ও সার্কেল অফিসও নির্মিত হয়নি এখনও। এর আগেই প্রকল্প উদ্বোধন এবং বাণিজ্যিক যাতায়াত শুরু হচ্ছে।

প্রস্তাবিত জনবল অনুমোদন পেয়েছে কি না জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পুলিশ সুপার প্রকৌশলী হাছান চৌধুরী বলেন, ‘প্রস্তাবিত জনবল অনুমোদন পেয়েছে কি না জানি না। তবে রেল কক্সবাজার যাচ্ছে। আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয় আছে। এই কারণে আমরা নিরাপত্তা দেওয়ার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ করেছি।’

একই বিষয়ে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীণ বলেন, ‘পুলিশের জনবল নিয়োগ, থানা-ফাঁড়ির প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে কি না তা এখনও জানি না। এই বিষয়ে রেলওয়ে পুলিশই ভালো বলতে পারবে।’

এর আগে গত অক্টোবরের শেষদিকে একটি প্রস্তাব রেল মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেই প্রস্তাবনা অনুযায়ী, দোহাজারী ও কক্সবাজার রেলস্টেশনে দুটি থানা স্থাপন, পটিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, রামু স্টেশনে ফাঁড়ি স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এসব ফাঁড়ি, থানা ও সার্কেলের জন্য সব মিলিয়ে দুই শতাধিক জনবলের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সেই জনবল অনুমোদিত হয়েছে কি না সেই বিষয়ে রেলওয়ে পুলিশ এবং প্রকল্প পরিচালক তথ্য দিতে পারেননি।

আরও খবর