দীপক দেব •
দুয়ারে কড়া নাড়ছে নির্বাচন। আগামী জানুয়ারির শুরুর দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন এমন দলগুলো ওই লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। তবে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্ররা সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে।
দাবি আদায়ে গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে ঘোষিত মহাসমাবেশের দিন সহিংসতায় পুলিশ হত্যা ও হামলা-অগ্নিসংযোগের মামলা এবং চলমান গ্রেপ্তার অভিযানে দলটির নেতাদের একটি অংশ কারাগারে গেছেন, বাকিরা রয়েছেন আত্মগোপনে। ওই ঘটনার পর আত্মগোপনে থেকে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিলেও বিএনপির নেতাকর্মীরা কার্যত ঘরে ঢুকে গেছেন। পশ্চিমা কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান জানালেও কোনো দলই তাতে সম্মতি দেয়নি। এতে রাজনৈতিক সমঝোতার পথ বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। চলতি মাসের মাঝামাঝি তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের জোরালো প্রস্তুতি শুরু হবে।
চলমান আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি ও তার মিত্ররা যে দাবি আদায় করতে পারবে না সে বিষয়টি এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে।
এ অবস্থায় বিএনপির সামনে দুটি পথ খোলা রয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ।
তিনি বলেন, বিএনপির সামনে এখন দুটি পথ রয়েছে। প্রথমটি, ২০১৪ সালের মতো নির্বাচনে অংশ না নিয়ে জ্বালাও-পোড়াও চালিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়টি, ২০১৮ সালের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণের পাশাপাশি আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া।
তিনি আরও বলেন, বিএনপির চলমান আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। কারণ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া শুধু রাজনৈতিক কর্মীদের অংশগ্রহণে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ বিএনপির দাবির পক্ষে সাড়া দেয়নি বলেই তাদের এ আন্দোলন সফল হওয়ার সুযোগ কম।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও প্রতিপক্ষ বিএনপিকে কোনো সুযোগ দিতে চায় না। এমনকি বিদেশি কারও চেষ্টা, চাপ কিংবা অনুরোধও আমলে নেয়নি দলটি। বিএনপিকে চলমান অবস্থার মধ্যে রেখেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। এ অবস্থায় বিএনপির সামনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ কমে আসছে।
অপরদিকে দলটিতে ভাঙনের গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়েছে। দলের ভেতরে একটি অংশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে। বিএনপি না গেলে স্বতন্ত্র বা সম্প্রতি নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দলে যুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন তারা। এতে সরকারেরও সবুজ সংকেত রয়েছে। তাদের চিন্তায় বরং বিএনপির বিকল্পই এখন বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। একাধিক সূত্র বলছে, বিএনপি নয়, আসন্ন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে ছোট দলগুলোর দিকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন নজর দিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা কিছু ছাড়ও দিতে পারে। জোটভুক্ত দলের বাইরেও কিছু দলের সঙ্গে আসন নিয়ে সমঝোতা হতে পারে।
যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে ততই গুরুত্ব বাড়বে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম) এবং তৃণমূল বিএনপির। বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনরত ছোট দলগুলোর সঙ্গেও ভেতরে ভেতরে সরকারি দলের যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি এরই মধ্যে নাকচ করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৮ অক্টোবরের সহিংসতা, পুলিশ হত্যা ও তার পরবর্তী সময়ে আগুনসন্ত্রাসের মতো কর্মকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ‘সেই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে না। সংলাপের পার্ট শেষ হয়ে গেছে।’
এদিকে ২৮ অক্টোবরের নাশকতা ও পুলিশ হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন মামলায় এরই মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির শীর্ষপর্যায়ের অনেক নেতাকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপরেও বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কারণে রাজনীতি সচেতন অনেকেই মনে করছে, দলটি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পুরোনো সিদ্ধান্তে অনড় থাকবে।
একই সঙ্গে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিও চালিয়ে যাবে। তবে তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল ভোটের প্রস্তুতি শুরু করলে অবরোধের কোনো প্রভাব থাকবে না বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রস্তুতি এবং সরকারের প্রতি তাদের যে আনুগত্য, তাতে নির্বাচনের দিনও বড় কোনো ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কম। আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদের চলমান সতর্ক পাহারার নামে মিছিল-সমাবেশ অব্যাহত রাখার নির্দেশনা রয়েছে। যেকোনো মূল্যে ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় তারা।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র মনে করে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসির পক্ষ থেকে আয়োজিত সর্বশেষ সংলাপে ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৬টি দলের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে বেশিরভাগ দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়।
সুতরাং বিএনপি বা তাদের সমমনা দলগুলোর কেউ কেউ নির্বাচনে না এলেও তাদের জন্য নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না। এজন্য বিএনপিকে নির্বাচনে আনার বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন দল কোনো তাগিদ বোধ করছে না, যা তাদের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যেও উঠে এসেছে।
নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের অনুকূলে আছে। জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, সংবিধানে এমন কিছু লেখা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে আওয়ামী লীগ ফাইনাল খেলার কথা বলছে, বিএনপি না থাকলে কার সঙ্গে ফাইনাল খেলবে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ফাইনাল খেলা তাদের সঙ্গে হবে, যারা মাঠে থাকবে। যারা মাঠে থাকবে না তাদের সঙ্গে তো খেলার প্রশ্নই আসে না।’
দলটির নেতারা জানান, আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। কারণ দেশের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন এবং ক্ষমতাসীন দল হিসেবে সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধরা রয়েছে তাদের। এই অবস্থায় সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করা বা এ ধরনের কোনো দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সংবিধান অনুযায়ী এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে কোনো দলের বাধা নেই।
বিএনপি-জামায়াতের দিকে ইঙ্গিত করে আওয়ামী লীগের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, কেউ যদি নির্বাচনে না এসে কর্মসূচির নামে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কায়দায় চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে গণতন্ত্রকে ব্যাহত করতে চায়, তাদের প্রতিহত করতে সরকার ও আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমরা চাই সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। আমরা কোনো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধা দিচ্ছি না। সাংবিধানিক ধারার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে দেশে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আশা করি সবাই তাতে অংশগ্রহণ করবে। তিনি বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, কেউ যদি গণতান্ত্রিক পথ পরিহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার স্বপ্ন দেখে তাদের দায়িত্ব এই দেশের জনগণ, সরকার, এমনকি আওয়ামী লীগও নেবে না। বিএনপি না এলেও নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে। কারও জন্য থেমে থাকবে না। আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে দলীয়ভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে।’
বিএনপি নির্বাচনে আসবে, কি আসবে না এটি দলটির দলীয় বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে নাকি অংশ নেবে না সেটা তাদের দলীয় বিষয়, এটা নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দলীয় প্রস্তুতির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে হতে যাওয়া এই বৈঠকে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রচার ও বিভিন্ন এলাকায় জনসভা, দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রিসহ নির্বাচনকেন্দ্রিক দলীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া তফসিলের আগ মুহূর্তে এই বৈঠক আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন দলটির অনেকেই।
বৈঠকে নির্বাচন বানচালে আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াতের চালানো ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ও দলটির চলমান অবরোধ ও আগামী দিনের সম্ভাব্য কর্মসূচি বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসতে পারে বলেও জানায় দলীয় সূত্র। এসব ক্ষেত্রে দলীয় কৌশল নিয়েও দিকনির্দেশনা আসতে পারে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে বলেও জানায় দলীয় সূত্র।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-