সুজাউদ্দিন রুবেল :
দু’পাড়ের মানুষের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন এখন দৃশ্যমান। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র তিন মিনিটের পথ। তারপরই চোখে পড়বে বাঁকখালী নদীর ওপর নব-নির্মিত সবচেয়ে সুন্দর সেতু। আর সেতুটির দু’প্রান্তে নির্মিত নতুন সড়ক। সেতু-সড়কের পাশেই বাঁকখালী নদী আর সারি সারি নারিকেল গাছ। পরিবেশগতভাবে অনেকটা হাওর অঞ্চলের মতো। আর সেতুটি নির্মিত হওয়ায় অর্থনীতিতে দারুণ সম্ভাবনা দেখছেন নদীর দু’পাড়ের স্থানীয় বাসিন্দারা।
বাঁকখালী নদীর ওপর নবনির্মিত সেতুর আনুষ্ঠানিক দ্বার খুলছে আগামী ১১ নভেম্বর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সেতুটি উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ প্রস্তাবিত আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ আরো একধাপ এগিয়ে যাবে।
সরেজমিন বুধবার (০৮ নভেম্বর) সকালে বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মিত সেতু এলাকা গিয়ে দেখা যায়, পুরো সেতুটি রঙ্গিন করে সাজানো হয়েছে। চলছে শেষ মুহুর্তে রং লাগানোর কাজে। একই সঙ্গে শ্রমিকরা ব্যস্ত লাইট লাগানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে। আর সেতুটির দু’প্রান্তে নতুন নির্মিত সড়কটিতেও চলছে শেষ মুহুর্তে কাজ।
কক্সবাজার পৌরসভার দীর্ঘদিনের আবর্জনার ভাগাড়ে যেন ফুল ফুটেছে। নদীর দুই পাড়ের মানুষের মেলবন্ধন করতে শিগগির ‘বাঁকখালী সেতুর’ দ্বার খুলছে। সেতু ও আশপাশের এলাকা ঘিরে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন এলাকাবাসী।
খুরুশকুল মনুপাড়ার বাসিন্দা ইউনুছ মিয়া বলেন, নব-নির্মিত এই সেতুর মাধ্যমে আমাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। এখানে আগে রাস্তা ছিলো না। ব্যবসা করতে কক্সবাজার শহরে যেতাম নৌকায় চড়ে। আগে খুরুশকুলে জমিজমার দাম কম ছিলো। কিন্তু এখন রাস্তা ও সেতু হওয়াতে জমি-জমার দাম অনেকগুণ বেড়ে যাবে। এখন খুরুশকুল এলাকাটিই শহরের মতো হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র এই সেতুটির কারণে। এখন আমরা গাড়িতে চড়ে কক্সবাজার শহরে মাত্র ৩ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবো।
একই এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘খুরুশকুলে লবন, চিংড়ি উৎপাদন একই সঙ্গে চাষাবাদ হচ্ছে। এখন এসব নিয়ে আমরা খুব দ্রুতই কক্সবাজার শহরে নিয়ে যেতে পারব আর বিক্রি করতে পারব। যেখানে আগে কক্সবাজার শহরে যেতে আধা ঘন্টা বা এক ঘন্টা লেগে যেতো সেখানে সেতুটি হবার ফলে মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে শহরে পৌছে যাব।’
আরেক বাসিন্দা শামশুল আলম (৬০) বলেন, সেতু ও সড়ক হওয়ার আমাদের বেশি সুবিধা হয়েছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই এই সেতুটি যিনি করে দিয়েছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আল্লাহ তাকে দীর্ঘ হায়াত দান করুন। এখন সেতু ও সড়কের কারণে অনেক খুশি লাগছে। আমাদের বেশি উপকার হয়েছে।
কস্তুরাঘাট এলাকার বাসিন্দা আবু তৈয়ব বলেন, কস্তুরাঘাট জায়গাটিতে আগে ময়লা-আবর্জনা ছিল। সেখান থেকে সরকার উন্নয়ন করেছে। বর্তমান সরকার যে সেতুটি নির্মাণ করেছে তা দুই পাড়ের মানুষের যাতায়াতের সংযোগই শুধু ঘটাবে না, দুই পাড়ে তৈরি হবে পর্যটনের নতুন হাব। এছাড়াও এখানে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প হয়েছে। সেটিও একটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, নাজিরটেকের বাসিন্দাদের জন্য বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় খুরুশকুলে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণাধীন। প্রথম ধাপে ছয়শ পরিবারকে স্থানান্তর করা হলেও প্রায় সাড়ে ৪ হাজার পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পে পর্যায়ক্রমে স্থানান্তর করা হবে। সেখানে যাতায়াতের জন্য বাঁকখালী নদীর উপর সেতু ও ৮ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার।
এলজিইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কস্তুরাঘাট সংলগ্ন বাঁকখালী নদীর উপর নির্মিত হচ্ছে ‘কক্সবাজার-খুরুশকুল’ সংযোগ সেতু। দীর্ঘ ‘প্রিস্টেইট বক্স গার্বার সেতু’। ৫৯৬ মিটারের এই সেতুর ব্যয় হচ্ছে ২৫৯ কোটি টাকা। সেতুটির আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের গত ১ সেপ্টেম্বর। সেতুটি ২০২১ সালের ২১ আগস্টের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারি ও নানা জটিলতায় শেষ হতে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত লেগেছে।
এদিকে আগামী ১১ নভেম্বর সেতুটির উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই সবার চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে সেতুটি।
প্রকল্প বাস্তয়ানকারী প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডি’র কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন খান বলেন, কক্সবাজার জেলাটা পর্যটন নগরী। সারা বিশ্বের কাছে পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার জেলা। কক্সবাজার শহরের উত্তর পাশে বাঁকখালী নদী প্রবাহমান।
এই বাঁকখালী নদীর পাড়েই যেই জায়গাটার মধ্যে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে যেটা ময়লার ভাগাড় পরিণত ছিল। সেই জায়গায় এখন একটি দৃষ্টিনন্দন সেতু এলজিইডির মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়েছে এবং গুণগত মানের বিষয়ে জিরো টলারেন্স রেখে আমরা এই সেতুটি নির্মাণ করেছি। এই সেতুটি নির্মাণের ফলে যে বিষয়টা আমাদের নতুন মাত্রা যোগ করেছে সেটি হলো পর্যটন শিল্প এবং আরেকটা দিক থেকে কক্সবাজার শহরকে সম্প্রসারণ করার ক্ষেত্রে এই সেতুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এলজিইডি কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন খান আরও বলেন, কক্সবাজার শহরের উত্তর দিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এখানে রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ চলছে। সেখানে যারা উদ্বাস্তু হিসেবে ছিলেন তাদেরকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিচ্ছে বর্তমান সরকার। সেক্ষেত্রে ৪ হাজার ৪’শ ৯টি পরিবারকে খুরুশকুল প্রান্তে তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তারাও এই সেতুটি ব্যবহার করে খুব সহজেই কক্সবাজারে তাদের নিত্যদিনের কার্যক্রম করতে পারবে। মূলত এই উদ্দেশ্যেই এই সেতুটি নির্মাণ করা হয়। এই সেতুটি নির্মাণের ফলে নবগঠিত ঈদগাও উপজেলার সঙ্গে দূরত্ব কমে যাবে। চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের দূরত্বও অনেক কমে যাবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-