সেন্টমার্টিন দ্বীপে চলছে ছয় শতাধিক যান, মাসে ১০ লাখ টাকা ‘চাঁদাবাজি’

আবদুর রহমান •

সেন্টমার্টিন রক্ষায় দ্বীপে মোটর ও যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানছে না কেউ। উল্টো পুলিশ ও স্থানীয় চেয়ারম্যানকে চাঁদা দিয়ে দ্বীপে যান চলাচলের বৈধতা নিচ্ছেন চালক ও মালিকরা। বর্তমানে ছয় শতাধিক যান চলাচল করছে। এতে দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে দ্বীপটি।

সেন্টমার্টিন রক্ষায় স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ, মোটর ও যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞাসহ বেশ কিছু বিধিনিষেধের কথা উল্লেখ করে গত ২৩ মে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। অথচ এই নিয়মের তোয়াক্কা না করে অবাধে সেখানে তোলা হচ্ছে ভবন, চলছে যানবাহন।

যানবাহন চালক ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপে অন্যান্য সময়ের তুলনায় পর্যটন মৌসুমে ছয় শতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান, মোটরযান চলাচল করছে।

প্রত্যেক যানবাহন থেকে মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা তুলছে টমটম-অটোরিকশা ভ্যান মালিক সমিতি। হিসাবে মাসে অন্তত ১০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এই টাকার বড় অংশ স্থানীয় চেয়ারম্যান, পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশের পকেটে যায়। বাকিটা সংগঠনের নেতারা ভাগ করে নেন।

কারণ দুই-তিন হাজার টাকা চাঁদা নিয়ে অবৈধ যানবাহনগুলোকে লাইসেন্স দিয়ে চলাচলের বৈধতা দিচ্ছে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মুজিবুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিপক্ষের লোকজন মিথ্যা কথাবার্তা ছড়াচ্ছেন। কোনও যানবাহন চালকের কাছ থেকে অবৈধভাবে টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। পরিষদ থেকে আমরা কোনও যানবাহনকে লাইসেন্সও দিচ্ছি না। তবে এটা সত্য, টমটম-অটোরিকশা ভ্যান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে দ্বীপের রাস্তা মেরামতের জন্য কিছু মালামাল কিনে দেওয়া হয়েছিল। আমি একাধিকবার এসব অবৈধ যানবাহনের বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। তারা এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

দ্বীপের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পর্যটন মৌসুম শুরু হওয়ায় সেন্টমার্টিনে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার অবৈধ যানবাহন চলাচল বেড়েছে। বৈধ কাগজপত্র না থাকলেও পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিদের চাঁদা দিয়ে এসব যানবাহন চলছে। দ্বীপে যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কেউ মানছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য (মেম্বার) বলেন, ‘চেয়ারম্যান টাকা নিয়ে অবৈধ যানবাহনসহ হোটেল-মোটেলগুলোকে লাইসেন্স দিচ্ছেন। ছয় শতাধিক যানবাহন দ্বীপে চলাচল করছে। এত যানবাহনের কোনও দরকার নেই। এসব যানবাহনে চার্জ দিতে সমুদ্রসৈকতের পাশে জেনারেটর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে আরেক গ্রুপ। ফলে দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে।’

সেন্টমার্টিনে প্রবাল, শৈবাল, কাছিম, শামুক, ঝিনুক, কড়ি, সামুদ্রিক মাছ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কাঁকড়াসহ এক হাজার ৭৬ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, বিপুলসংখ্যক পর্যটকের গমন ও পরিবেশদূষণের কারণে দ্বীপটি সংকটাপন্ন হয়েছে। দেশের ১৩টি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) একটি সেন্টমার্টিন দ্বীপ।

এর অর্থ হলো, দ্বীপের পানি, মাটি, বায়ু বা প্রাণীর ক্ষতি করে—এমন কোনও কাজ সেখানে করা যাবে না। এ কারণে সেখানে কোনও স্থাপনা নির্মাণে ছাড়পত্র দেয় না পরিবেশ অধিদফতর। তবু এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করে অবাধে সেখানে তোলা হচ্ছে ভবন, চলছে যানবাহন। এতে দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে দ্বীপটি।

দ্বীপে জাহাজ থেকে নেমে দেখা গেছে, শত শত অটোরকিশা ও ভ্যান। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সৈকতে চলছে টমটম এবং মোটরবাইক। পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেলেও চালকদের বাধা দিতে দেখা যায়নি।

জেটি থেকে নেমে স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ নাহিদের অটোরিকশায় করে দ্বীপের পশ্চিম পাড়ায় যান এই প্রতিনিধি। এ সময় দ্বীপে এত যানবাহন কেন জানতে চাইলে নাহিদ বলেন, ‘এর সব দায় পুলিশ এবং স্থানীয় চেয়ারম্যানের। তারা টাকা নিয়ে এসব যানবাহন চলাচলের বৈধতা দিচ্ছেন। মাসে দেড়-দুই হাজার টাকা আমাদের দিতে হচ্ছে। টাকা না দিলে দ্বীপে গাড়িতে চালাতে দেন না সমিতি ও চেয়ারম্যানের লোকজন।’

অধিকাংশ গাড়ির কাগজপত্র নেই উল্লেখ করে নাহিদ আরও বলেন, ‘আমরা যা আয় করি আর না করি, সমিতিকে দৈনিক ৫০ টাকা দিতে হয়। এই টাকা থেকে চেয়ারম্যান ও পুলিশের পকেটে যায়। তবে চালকরা সমিতি থেকে কিছুই পান না। গত দুই বছর ধরে সেন্টমার্টিন দ্বীপে অটোরিকশা চালাচ্ছি। প্রতিদিন তাদের টাকা দিতে হয়। টাকা দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চলাচলের পারমিট নিয়েছি। পাশাপাশি সমিতিকে এককালীন পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছি। সব চালককে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে সমিতিভুক্ত হতে হয়।’

দ্বীপে পাঁচ বছর ধরে মোটরবাইক ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছেন মোহাম্মদ আলম। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেড় শতাধিক বাইক দ্বীপে চলাচল করছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর চাঁদার টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। প্রতিটি বাইক চালানোর জন্য পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশকে এক থেকে দুই হাজার টাকা করে দিতে হয়। দ্বীপে আমার মোটরবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও সাইকেল চলছে ২০টির মতো। এসব যান চলাচলের অনুমতি নিতে মাসিক এবং দৈনিক চাঁদা দিতে হয়। না হলে জব্দ করে নিয়ে যায় পুলিশ। এছাড়া যানগুলোকে সমিতির তালিকাভুক্ত করতে ছয় থেকে ১০ হাজার করে টাকা দিতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও এই কাজে জড়িত।’

দ্বীপের বাসিন্দা নুরুল আলম বলেন, ‘দ্বীপে যান চলাচল ও প্রত্যেক হাট থেকে চাঁদা তুলতে বাহিনী গড়ে তুলেছেন চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান। ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। একপ্রকার তার হাতে জিম্মি আমরা।’

দ্বীপে চলাচলকারী যানগুলো থেকে চাঁদা তোলার কথা স্বীকার করেছেন সেন্টমার্টিন টমটম-অটোরিকশা ও ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি মো. ইসহাক।

তিনি বলেন, ‘যানবাহন থেকে আমরা সংগঠনের জন্য কিছু টাকা তুলি। এসব টাকা লাইনম্যানসহ অফিসের জন্য খরচ করা হয়।’ সমিতিভুক্ত হতে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে, সে টাকাগুলো কোন কাজে ব্যবহার করা হয়; জানতে চাইলে ইসহাক বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন বিস্তারিত বলতে পারবো না।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ কেউ আমাকে জানায়নি। যেহেতু বিষয়টি এখন শুনেছি, তদন্ত করে দেখবো। যারা এ ধরনের ঘটনায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

দ্বীপের রাস্তার মাথায় সমিতির লাইনম্যান পরিচয় দিয়ে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে আটকে দেন মো. হামিদ নামে এক ব্যক্তি।

কিসের টাকা তুলছেন জানতে চাইলে হামিদ বলেন, ‘টমটম সমিতির টাকা তুলছি। দৈনিক সবার কাছ থেকে ৫০ টাকা করে নেওয়া হয়। না হয় গাড়ি চালাতে দেওয়া হয় না। এই টাকা সমিতিতে জমা হয়। পরে চালকদের জন্য খরচ করা হয়। এ সময় অটোরিকশাচালক বলেন, ‘এ যাবতকালে সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনও অনুদান কিংবা সহযোগিতা পাইনি। আমাদের জন্য এক টাকাও খরচ হয় না।’

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেন্টমার্টিন সৈকতে মোটর ও যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচলের কারণে কাঁকড়ার প্রজনন কমে গেছে। জেনারেটর চালিয়ে যানবাহন চার্জসহ অপরিকল্পিত পয়োনিষ্কাশন এবং যত্রতত্র আবর্জনা ফেলে পানি, মাটি দূষণের কারণে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। দ্বীপ থেকে প্রবাল আহরণ নিষিদ্ধ। কিন্তু কে শোনে কার কথা, অবাধে প্রবাল আহরণ চলছে। দ্বীপবাসী ফেরি করে বিক্রিও করছে প্রবাল।

দ্বীপের উত্তর পাড়ার বাসিন্দা রশিদ উল্লাহ (৬৫) বলেন, ‘দ্বীপের কথা কেউ ভাবছে না। আসলে এখানে যে যার মতো টাকার লোভে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। টাকার জোরে এখানে সব বৈধতা পাচ্ছে। তা না হলে কেন এত ছোট দ্বীপে এত যানবাহন।

কয়েক বছর আগেও দ্বীপে কেয়াবন, নারিকেল গাছের বাগান, নিশিন্দা বাগানসহ অন্যান্য গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ ছিল। ঘন জঙ্গলে ছিল বিচিত্র সব প্রাণী। কিন্তু এখন সব হারিয়ে যাচ্ছে। দ্বীপ নিয়েই চলছে এক ধরনের ব্যবসা। ফলে দ্বীপটি এখন মৃত্যুর মুখে।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ‘দ্বীপে চলাচলকারী অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করবো। যারা অবৈধ যানবাহনকে বৈধতা দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবো।’

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কোনোভাবেই আর্থিক সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই কারও। পুলিশের কোনও সদস্য এর সঙ্গে জড়িত কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি সব সংস্থার সঙ্গে কথা বলে অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আরও খবর