সুজাউদ্দিন রুবেল •
# সিদ্ধান্ত ছাড়া ফিরে গেলো মিয়ানমারের ৩৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোন ধরণের সিদ্ধান্ত ছাড়াই ফিরে গেলো মিয়ানমারের ৩৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল। ভূমি অধিকার নিশ্চিতের আশ্বাস না পাওয়ায় স্বদেশে ফিরতে মন গলেনি রোহিঙ্গাদের। তাদের দাবি, প্রত্যাবাসন নিয়ে দফায় দফায় ছলচাতুরি করছে মিয়ানমার।
অন্যদিকে প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও টেকসই প্রত্যাবাসনে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ সরকার।
মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর হাতে বাস্তুচ্যুত হওয়া রশিদা বেগম নিজ দেশে ফিরতে চান। তাই মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের কাছে চেয়েছিলেন ভিটে-মাটি ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা। কিন্তু আশ্বাস না পাওয়ায় স্বদেশে ফিরতে মন গলেনি তার।
টেকনাফস্থ জাদিমুরা ২৭ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা রশিদা বেগম (৬০) বলেন, ৯৮টি গ্রামের মানুষ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখন তাদের মিয়ানমারে ২০টি গ্রামের মধ্যে বসতি করে দেবে। আমরা সরাসরি মিয়ানমারকে বলে দিয়েছি রাজি না। মিয়ানমারে গিয়ে ক্যাম্পে চাল, ডাল, তেল কিছুই লাগবে না।
তাদেরকে শুধু বলেছি, বসত ভিটে ফেরত দাও চলে যাব।
শুধু রশিদা বেগম নন, মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে যারাই কথা বলেছেন- তাদের সবারই চোখেমুখে হতাশা।
রোহিঙ্গারা বলছেন, বরাবরের মতো প্রত্যাবাসন নিয়ে ছলচাতুরিতে ব্যস্ত মিয়ানমার। টালবাহানা করতেই দফায় দফায় আলোচনার কথা বলছে মিয়ানমার। নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকার ও সুরক্ষার সঙ্গে প্রত্যাবাসন দেশটির মূল লক্ষ্য নয়।
টেকনাফ শালবাগান ক্যাম্পের রাফিয়া বেগম (৩৮) বলেন, মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা আমাদের নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পে রাখার কথা বলেছেন। আমাদের জন্য কী কী সুবিধা দেওয়া হবে সেই ভিডিও দেখিয়েছে। কিন্তু আমরা সেভাবে ফিরতে চাই না। আমাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, লেখাপড়া, চিকিৎসা, চলাচল ও নিরাপদ জীবনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিনিধি দল দেশে (মিয়ানমার) ফিরে তাদের দাবির বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষকে জানাবে বলে আশ্বস্ত করেন।
জাদিমুড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা এনায়েত উল্লাহ বলেন, তারা আমাদের আবারও ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমরা ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য কোনোভাবেই রাজি না। আমরা জাতীয়তা, নিরাপত্তা, বাপ-দাদার ভিটেমাটি পেলে যাওয়ার জন্য রাজি।
মোহাম্মদ হারেছ (২২) বলেন, মিয়ানমার আমাদেরকে যে সুযোগ-সুবিধা দেখাচ্ছে বা প্রক্রিয়া দেখাচ্ছে তা আগের মতো। তাদের এই প্রক্রিয়ায় তো আমাদের যাওয়া হবে না। মিয়ানমার আমাদেরকে ভিন্ন গ্রামে ঘর করে দিবে বলছে, কিন্তু আমি তো নিজ গ্রামের ভিটে-মাটিতে যেতে চাই।
মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) সকাল ৮টায় প্রত্যাবাসন ইস্যুতে সীমান্তের নাফ নদী পাড়ি দিয়ে দুটি ট্রলারে করে টেকনাফ আসে মিয়ানমারের ৩৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল। এরপর প্রতিনিধি দলকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে গাড়িযোগে আনা হয় টেকনাফের দুটি সরকারি রেস্ট হাউসে। একই সময়ে নেয়া হয় ১৮০ জন রোহিঙ্গাকে।
তাদের মধ্যে ৮০ জন রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাই করে মিয়ানমার প্রতিনিধিদের একটি দল। আর ১০০ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে ৩ ঘন্টাব্যাপি চলে আলোচনা। তবে আগের দুই দফার মতো এবারো কোনো ফল আসেনি। সিদ্ধান্তহীন আলোচনা শেষে ফিরে যায় মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি। এদিন গণমাধ্যমে কথা বলেনি দেশটির কোনো সদস্য।
মিয়ানমার প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব দেন রাখাইন প্রাদেশিক সরকারের ইমিগ্রেশন ডিরেক্টর স নাইং। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার বিষয়ক সেলের মহাপরিচালক মিয়া মো. মাইনুল কবির। এ সময় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান, অতিরিক্ত আরআরআরসি মো. সামছু-দ্দৌজাসহ এপিবিএন পুলিশের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রত্যাবাসন চুক্তির পর, ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর ও ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট দিনক্ষণ ঠিক হলেও তা ভেস্তে যায় মিয়ানমারের ছলচাতুরিতে। এরপর চলতি বছর চীনের মধ্যস্থতায় নতুন করে আলোচনায় আসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। ৩ দফায় দেশটির প্রতিনিধি দল আসলেও প্রশ্নের মুখেই রয়েছে মিয়ানমারের অবস্থান।
এদিকে মিয়ানমারের ৩৬ সদস্যের প্রতিনিধি দলের দিনব্যাপী আলোচনা শেষে মঙ্গলবার বিকালে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার বিষয়ক সেলের মহাপরিচালক মিয়া মো. মাইনুল কবির বলেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিয়ে সরকার কাজ করছে। সরকার সবসময় রোহিঙ্গা সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধানের উপর গুরুত্বারোপ করে আসছে।
রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে নিজেদের জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে সেই বিষয়ের গুরুত্ব দিয়ে আসছে। প্রত্যাবাসন একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশ সরকারের একটা চুক্তি হয়েছে। চুক্তির আওতায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যাতে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমার ফিরে যায়।
তিনি বলেন, এর আগে চলতি বছর মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল দুইবার রোহিঙ্গাদের সাথে আলাপ করতে এসেছিল। এসময় তারা (মিয়ানমার প্রতিনিধি) রোহিঙ্গাদের জন্য সেখানে (মিয়ানমার) যে ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- তা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আজকেও তারা সুনির্দিষ্ট করে বলেছে, কোন গ্রামে কে যাবে; কিভাবে যাবে। এই আলোচনাটা আমাদের সঙ্গে অব্যাহত আছে, অব্যাহত থাকবে।
তবে রোহিঙ্গারা কখন স্বদেশে ফিরে যাবেন সেটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে বলে মন্তব্য করেন মাইনুল কবির বলেন, “রোহিঙ্গারা শুধু এখান (বাংলাদেশ) যাওয়াটাই নয়, যাওয়ার পরও যেন তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে এবং প্রত্যাবাসনটাও যেন টেকসই ও স্থায়ী হয়; সে জন্য মিয়ানমারের সাথে আলোচনা করে প্রচেষ্টা চলছে।”
প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গাদের সংশয় ও অবিশ্বাস দূর করতে মিয়ানমারের সাথে সবধরণের আলোচনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ মহাপরিচালক।
আর শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিনিধি দলটি দু’দলে বিভক্ত হয়ে ১৮০ জন রোহিঙ্গা পরিবারের প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। মূলত প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের সম্মতি আদায়ে এই আলোচনা চলছে।
“আলোচনার জন্য আসা কয়েকজন রোহিঙ্গা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এই আলোচনার মধ্য দিয়ে নিজ ভিটে-মাটি ও নাগরিকত্ব দিলেই স্বদেশে ফিরবেন তারা। আর দু’পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান হবে বলে আশা করছেন তিনি।”
মো. মিজানুর রহমান বলেন, “আমাদের যে প্রচেষ্টা সেটি হচ্ছে প্রত্যাবাসনটা শুরু করার পর্যায়ে চলে যাওয়া। প্রত্যাবাসনটা যাতে টেকসই হয়, মর্যাদাপূর্ণ হয়- সেটা নিশ্চিত করা।”
২০১৮ সালে কয়েক দফায় ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে হস্তান্তর করে বাংলাদেশ। তারমধ্যে মাত্র ১ লাখ ১ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা ভেরিফাই করে মিয়ানমার সরকার। এরপরও প্রত্যাবাসন কার্যক্রম এগিয়ে নিতে মংডুর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে গিয়েছিলেন রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল।
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয়রত রয়েছেন। কিন্তু গত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-