নিজস্ব প্রতিবেদক :
কক্সবাজারে দুদকের গণশুনানিতে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে সেবা পেতে হয়রানি, ঘুষ ও দুর্নীতির শিকার ভুক্তভোগীদের অভিযোগের যেন শেষ নেই। দুদকে জমা হওয়া ১০৯ টি অভিযোগের হয়রানির শিকার ভুক্তভোগীরা একের পর এক তথ্য প্রমাণ নিয়ে মঞ্চে উঠে হয়রানির কথা জানান।
এসময় দুদকের পরিচালক (তদন্ত) মো: জহুরুল হক তাদের কথা শুনেন এবং আগামী ৭ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে অধিকাংশ অভিযোগের নিষ্পত্তি ও প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। শুনানিতে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পড়ে জেলা প্রশাসনের জমি অধিগ্রহণের (এলএ) নিয়ে। এসময় অনেকক্ষেত্রে রেলওয়ে, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ জেলায় সরকারের চলমান মেগাপ্রকল্পের টাকা কার নামে কে তুলে নিয়ে গেছে তাঁর সঠিক ব্যাখা দিতে পারেননি খোদ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বুধবার (১১ অক্টোবর) সকাল ১০ টায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আয়োজিত গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গণশুনানিতে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল, পাসপোর্ট অফিস, বি.আর.টি.এ. সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, সহকারী কমিশনার (ভূমি), সমাজসেবা অফিস, নির্বাচন অফিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ বিভাগ, শিক্ষা অফিস, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং পৌরসভাসহ মোট ২৬ টি দপ্তরের ১০৯ টি অভিযোগ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে ৭৯ টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ শুনানির জন্য সেবা প্রার্থী জনসাধারণ সরাসরি উপস্থাপন করেছেন।
উপস্থাপিত ৫৮ টি অভিযোগের মধ্যে ০২ টি দুর্নীতির বিষয়ে কমিশন কর্তৃক অনুসন্ধান করার জন্য প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ৫৬ টি অভিযোগের তাৎক্ষনিকভাবে সমাধান করা হয়।
গণশুনানিতে কক্সবাজারের বিভিন্ন দপ্তরে সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ, দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার, সেবা প্রত্যাশীরা কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট অভিযোগ উত্থাপন করেন। তাদের অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্তকর্তাগণ শুনেছেন এবং কিছু অভিযোগের সমস্যা সমাধান করার জন্য তাৎক্ষনিক ভাবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশনা প্রদান করেছেন এবং অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে পরবর্তীতে কমিশন যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে দুদক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার আশ্বাস দিয়েছেন।
এছাড়া তদন্তে কোন অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা প্রদান করেন দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মো. জহিরুল হক।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গণশুনানির আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহিরুল হক বলেন, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে সরকারি সেবা সে কোন মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে সততা, নিষ্ঠা, জবাবদিহিতা ও মূল্যবোধ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহবান জানান তিনি।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নামের একজন ভুক্তভোগী বলেন, দীর্ঘদিন থেকে এল এ শাখায় অধিগ্রহণের টাকা আছে কিন্তু পাচ্ছি না। তাঁর এমন অভিযোগে জেলা প্রশাসক বলেন, এটা নিয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে। তবুও আপনি আমার সাথে দেখা করবেন এবং আমি সুরাহা করে দিবো।
ছৈয়দ আলম নামের এক প্রবাসী বলেন, ‘আমার পৈত্রিক সম্পত্তি রেলওয়েতে অধিগ্রহণে পড়েছে। আমি আবেদনও করেছি কিন্তু কোনোভাবে টাকা উত্তোলন করতে পারিনি। যার খতিয়ান নং ২৭৮ ও দাগ নং ৯৪৪৬। পরে খবর পেলাম নজির আহমেদ ও খোরশেদ আলম সেই টাকা তুলে নিয়ে যায়। তার এমন অভিযোগে জেলা প্রশাসক বলেন, কাগজপত্র নিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। আমি টাকা আপনাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।’
শওকত আলম বলেন, ‘একটি সিন্ডিকেট আমার বোনকে দিয়ে অধিগ্রহণের প্রায় কোটি টাকা তুলে নিয়ে যায়।’
রাশেদুল করিম বলেন, ‘আমি ২য় বারের মত দুদকের শুনানিতে অংশ গ্রহন করছি। একই অভিযোগ নিয়ে ২০১৮ সালে আর-ও একবার দুদকের গণশুনানিতে অংশ নিয়েও কোন কাজ হয়নি।’ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য নির্দেশনা দেন দুদক কমিশনার।
জাহেদ হোসেন বলেন, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬ একর জায়গার মধ্যে বুঝে পেয়েছি ৩ একর জায়গা। ২০১৫ সালে এলও শাখায় মামলা করি। কিন্তু গত ৭ বছর পার হলে-ও এখনো জায়গা ফেরত পায়নি। এছাড়া জেলা প্রশাসনের এল এ শাখার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ ভুক্তভোগীরা তুলে ধরেন।
এসময় জেলা প্রশাসক বেশকিছু অভিযোগ আমলে নিয়ে বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণ ও টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকক্ষেত্রে হয়তো দীর্ঘসূত্রীতা হচ্ছে কিন্তু ক্ষতিপূরণের টাকা বিতরণে স্বচ্ছতা জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য যা যা করার প্রয়োজন সব করা হচ্ছে। দুদক কমিশনার জহিরুল হক এ ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান।’
শুনানিতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে মেডিকেল সনদ বাণিজ্য, সমবায় কর্মকর্তার টাকা আত্মসাৎ, পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ বাণিজ্য ও দালাল চক্রের বিষয়ে অভিযোগ তোলা হয়। যা সমাধানের নির্দেশও দেওয়া হয়।
রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নিয়ে জহিরুল হক বলেন, ‘পাসপোর্ট নিয়ে হয়রানির অভিযোগের শেষ নেই। সব পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য থাকে। পাসপোর্টে সমস্যার নাম করে হয়রানি করা যাবেনা।’
এসময় উপস্থিত ছিলেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন, দুদক চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. মাহমুদ হাসান, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম, দুদক সমন্বিত কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম, কক্সবাজার জেলা দূর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বকুল, বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, সকল সরকারি দপ্তর প্রধান, জনপ্রতিনিধিসহ সুশীল সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকেরা।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-