বিশেষ প্রতিবেদক •
কয়েকদিন আগেও পর্যটকশূন্য ছিল বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত।
তবে বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে কক্সবাজারে পর্যটকদের ঢল নেমেছে। সমুদ্রসৈকতের লাবণী থেকে কলাতলী পয়েন্টের তিন কিলোমিটার এলাকা জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছে।
ইতিমধ্যে আগামী শনিবার পর্যন্ত শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট-গেস্টহাউসের সব কক্ষ বুকিং হয়ে গেছে। তবে সপ্তাহব্যাপী বিচ কার্নিভাল উপলক্ষে হোটেল-রেস্তোরাঁ, গণপরিবহন ও উড়োজাহাজসহ ১৫টি খাতে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন পর্যটকরা।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তিন দিনের ছুটিতে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ঘুরতে এসেছেন লাখো পর্যটক। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সপ্তাহব্যাপী পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভাল। ফলে লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। উৎসবে মেতেছে পুরো কক্সবাজার। শুধু সমুদ্রসৈকত নয়, পর্যটকরা ছড়িয়ে পড়েছেন জেলার আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলোতে। তাদের জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও জেলা প্রশাসন। আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে বিচ কার্নিভালের নানা অনুষ্ঠান। ফলে আরও পর্যটকের আগমন ঘটবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সমুদ্রসৈকতজুড়ে সাজ সাজ রব। সবচেয়ে সুন্দর করে লাবণী পয়েন্ট সাজানো হয়েছে। সৈকতের পূর্বমুখী করে তৈরি হয়েছে বিশাল মঞ্চ। মঞ্চের সামনে লাবণী সড়কের দুই পাশে সারি সারি অস্থায়ী দোকানও নির্মাণ করা হয়েছে। কল্লোল হোটেলের সামনে তিন রাস্তার মুখে বসানো হয়েছে কাঠের তৈরি রঙিন নৌকা। এসব স্থান লোকে লোকারণ্য। শুধু সৈকত নয়, দিনব্যাপী সেন্টমার্টিন, ইনানীর পাথর রানি সৈকত, হিমছছড়ি ঝরনা, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, শহরের বার্মিজ মার্কেট, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক ও রামুর বৌদ্ধ বিহারসহ সবগুলো বিনোদনকেন্দ্রে ঘুরেছেন পর্যটকরা।
বিকালে সৈকত ঘুরে দেখা গেছে, লাবণী থেকে কলাতলী পয়েন্টের তিন কিলোমিটার এলাকা জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছে। তাদের কেউ এসেছেন বন্ধুদের সঙ্গে, কেউ পরিবার নিয়ে। ভ্রমণপিপাসুদের কেউ সৈকতের বালিয়াড়িতে ঘোরাঘুরি করছেন, কেউ বিচ বাইক, জেটস্কি ও ঘোড়ায় চড়ে আনন্দ উপভোগ করছেন। কেউ সাগরের নীলজলে গোসল করছেন আবার কেউ সমুদ্র ও প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবসকে কেন্দ্র করে সৈকতে বিচ কার্নিভালের (মেলা) আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসন ও সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটি। মেলায় মুক্ত আলোচনার পাশাপাশি পর্যটকদের মন মাতাচ্ছেন দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডের সংগীত শিল্পীরা। মেলা চলবে আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত।
জেলা প্রশাসন ও পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানান, সপ্তাহব্যাপী বিচ কার্নিভাল উপলক্ষে হোটেল-রেস্তোরাঁ, গণপরিবহন ও উড়োজাহাজসহ ১৫টি খাতে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিনামূল্যে উৎসব উপভোগের সুযোগও রাখা হয়েছে। এবারের উৎসবে অন্তত পাঁচ লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। আয়োজকরা জানান, এবারের কার্নিভালে দর্শক মাতাবেন দেশের বিখ্যাত ব্যান্ড দল চিরকুট, আভাস, সুনামগঞ্জের শাহ আবদুল করিমের দল, কুষ্টিয়ার লালন গীতির দল, সিলেট, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহের পালা গানের দলসহ জনপ্রিয় ব্যান্ড ও সংগীত শিল্পীরা। নৃত্য পরিবেশন করবেন তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিসহ কক্সবাজারের রাখাইন সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টা পর্যন্ত সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যটকদের ভিড় ছিল। লাবণী পয়েন্টে বিচ কার্নিভালের জমকালো অনুষ্ঠানে ছিলেন হাজারো পর্যটক। পুরো শহর উৎসবের নগরীতে রূপ নিয়েছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাড়ের কথা শুনে তিন দিনের ছুটি থাকায় সপ্তাহব্যাপী পর্যটন মেলা উপভোগ করতে সড়কপথের পাশাপাশি আকাশপথেও কক্সবাজারে এসেছেন পর্যটকরা।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক গোলাম মর্তুজা হাসান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার কক্সবাজার বিমানবন্দরে রেকর্ডসংখ্যক ফ্লাইট ওঠানামা করেছে। গত দুই দিনে ঢাকা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে বিমানের ফ্লাইট নেমেছে ৪৯টি। এটা বিমানবন্দরের অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এখানে ওঠানামা করেছে ২৪টি ফ্লাইট। যা বিমানবন্দরের ইতিহাসে রেকর্ড। বিচ কার্নিভাল ও টানা ছুটিতে যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী এত ফ্লাইট পরিচালনা করেছি আমরা।’
তবে পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভাল উপলক্ষে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হলেও, তা অধিকাংশ হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট ছাড় দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক পর্যটক। একইসঙ্গে সার্বিক নিরাপত্তা এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
কুমিল্লা থেকে আসা সোহেল, আরমান হোসেন ও রিমনের অভিযোগ, ‘১৫টি খাতে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের ঘোষণা শুনে বুধবার কক্সবাজারে ঘুরতে এসেছি। কিন্তু ওই দিন একাধিক হোটেল-মোটেলে গিয়ে কোনও ছাড় পাইনি। উল্টো কক্ষ খালি নেই বলে বেশি দাম নিয়েছেন হোটেল মালিক।’
পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভাল উপলক্ষে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ছাড়ের কথা শুনে ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে কক্সবাজারে ঘুরতে এসেছেন সজিব হোসেন ও রেখা মনি দম্পতি। ইনানী সমুদ্রসৈকতে এই দম্পতির সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, ‘আজ সকালে এসেছি আমরা। কলাতলীর একটি হোটেল উঠেছি। কিন্তু মেলা উপলক্ষে যে ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তা পাইনি আমরা। কক্ষ খালি নেই বলে আগের মতোই ভাড়া নিয়েছে। রেস্টুরেন্টের খাবারে ছাড়ের কথা বললেও আগের দামই নেওয়া হচ্ছে।’
বিষয়টি পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী কিংবা জেলা প্রশাসনের কাউকে জানিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে সজিব হোসেন বলেন, ‘জানালে কি হবে ভাই? তারা বলছে, কক্ষ খালি নেই। আপনি কোথায় উঠবেন, আর ঘুরতে এসে এসব নিয়ে অভিযোগ করা যায়? উল্টো ঝামেলায় পড়তে হবে।’
নারায়ণগঞ্জ থেকে সপরিবারে ঘুরতে আসা সরকারি চাকরিজীবী ইকবাল হোসেন বলেন, ‘বুধবার বিকালে ছাড়ের কথা শুনে এখানে এসেছি। তিনটি হোটেল-মোটেলে গিয়ে ছাড়ের বিষয়ে জানতে চেয়েছি। তারা বলছে, কক্ষ খালি নেই। পরে অন্যদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, তারা পর্যটকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। শেষে বেশি দামে কক্ষ ভাড়া নিয়েছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলাতলী হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মৌখিন খান বলেন, ‘দুই-একটি হোটেল-মোটেলের মালিক এমনটি করতে পারে। বিষয়টি অস্বীকার করছি না। তবে গত দুই দিন ছাড় দেওয়া হয়েছে, এটা সত্য। এরই মধ্যে লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। হোটেলগুলোর সব কক্ষ বুকিং থাকায় হয়তো কেউ কেউ এ সুযোগে বাড়তি ভাড়া নিচ্ছেন। তবে আমরা কোনও অভিযোগ এখনও পাইনি।’
ছাড় না দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, ‘আগামী শনিবার পর্যন্ত শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট-গেস্টহাউসের সব কক্ষ বুকিং হয়ে গেছে। লক্ষাধিক পর্যটক এসেছেন। গত কয়েকদিন ধরেই ছাড় চলছে। শেষ সময়ে যারা এসেছেন হয়তো তারা ছাড় পাননি। আবার কক্ষ না থাকার কথাও সত্য। না থাকলে দেবে কীভাবে? ভাড়া বেশি নেওয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’
পর্যটকদের নিরাপত্তায় পুরো সমুদ্রসৈকত ও আশপাশের এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে বলে জানালেন ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের পুলিশ সুপার জিল্লুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘মেলায় নিরাপত্তায় ঘাটতি নেই। বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে সৈকতে কয়েক লাখ পর্যটকের সমাগম আশা করা হচ্ছে। পর্যটন দিবস উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী চলমান পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভাল ঘিরে পর্যটকদের জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে তারা। কোনও পর্যটন স্পটে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
হোটেলে বেশি ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘পর্যটকদের হয়রানি রোধে মাঠে কাজ করছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। যেখানে অনিয়ম হবে, সেখানে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা চাই, অন্যান্য বছরের তুলনায় আরও পর্যটক আসুক। পর্যটন শিল্পের বিকাশ হোক।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-