নির্বাচনি ‘পর্যবেক্ষক’ নিয়ে ফের আলোচনায় ইসি

ডেস্ক রিপোর্ট •

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনি পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। আর এ ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে লুফে নিয়েছে সরকারবিরোধী দলগুলো।

একদিকে মার্কিন ভিসানীতি অন্যদিকে ইইউর পর্যবেক্ষক টিম না পাঠানোকে কেন্দ্র করে সরগরম দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন।

প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভূমিকা নিয়েও। তবে নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে পর্যবেক্ষক থাকতেই হবে এর কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। বরং দেশের গণমাধ্যমই যথেষ্ট। তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারলে পর্যবেক্ষকের প্রয়োজন নেই।

আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নভেম্বরে হবে তফসিল ঘোষণা। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে ইসি। সবকিছু ঠিকঠাক চললেও নির্বাচনি ‘পর্যবেক্ষক’ নিয়ে ফের আলোচনায় উঠে এসেছে নির্বাচন কমিশন। দেশি ও বিদেশি দুই ধরনের পর্যবেক্ষক নিয়েই সংকটে পড়েছে ইসি।

গত ১৮ জানুয়ারি দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনের জন্য প্রথমবারের মতো আবেদন আহ্বান করেছিল ইসি। সে সময় ২১০টি সংস্থা আবেদন করেছিল। এর মধ্যে গত ৮ আগস্ট প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ ৬৮টি সংস্থার তালিকা প্রকাশ করে সংস্থাটি এবং তাদের বিরুদ্ধে দাবি-আপত্তি জানাতে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় ইসি। এতে দুটি সংস্থার নাম নিয়ে আপত্তি উঠলে ৬৬টি সংস্থাকে নিবন্ধন দেয় কমিশন।

অন্যদিকে গতবারের চেয়ে পর্যবেক্ষক সংস্থার সংখ্যা অর্ধেকের মতো কমে যাওয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো গত ১৫ সেপ্টেম্বর ১০ দিনের জন্য ফের আবেদন আহ্বান করে ইসি। যার সময় শেষ হয়েছে রোববার। দ্বিতীয়বারের বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে দেড় শতাধিক আবেদন জমা পড়েছে। আগের বারের বাদ পড়াদের মধ্য থেকেই বেশি আবেদন এসেছে।

ইসির জনসংযোগ শাখার সহকারী পরিচালক মো. আশাদুল হক জানিয়েছেন, তালিকা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে দেড় শতাধিক আবেদন জমা পড়েছে। ২০০৮ সাল থেকে ভোট পর্যবেক্ষণের জন্য পর্যবেক্ষক নিবন্ধন দিচ্ছে ইসি। সে সময় ১৩৮টি সংস্থা নিবন্ধন পেয়েছিল। সবশেষ ২০১৮ সালে ১১৮টি সংস্থাকে নিবন্ধন দিয়েছিল ইসি।

অন্যদিকে গত চলতি বছরের জুলাইয়ে নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে দুই সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশ সফর করেছে ইইউর ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল (স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দল)। প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলটির প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানানোর কথা ছিল ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলের।

কিন্তু গত ২১ সেপ্টেম্বর নির্বাচন ভবনের নিজ দফতরে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাংগীর আলম সাংবাদিকদের জানান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) মেইলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব ডেলিগেশন একটি ই-মেইল পাঠিয়েছেন।

মেইলে ইইউ অ্যাম্বাসেডর চার্লস হোয়াইটলি সিইসিকে লিখেছেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাজেট স্বল্পতার কারণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। চিঠিতে আরও বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা পরিষ্কার নয় যে, নির্বাচনের সময় সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণ হবে কি না। তবে তারা পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠালেও সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে অন্যান্যভাবে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় সহায়তা দেবে এবং যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে।

ইইউর চিঠির জবাবে গত ২৩ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষর করা এক চিঠিতে সিইসি চার্লস হোয়াইটলিকে বলেন, গত ১৯ সেপ্টেম্বর আমি আপনার চিঠি পেয়েছি, যেখানে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সব সহায়তা নেওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব বলে আপনাকে আশ্বস্ত করছি।

নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চিঠির জবাব দিয়েছেন। আমরা আশা করি, অল্প পরিসরে হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক পাঠাবে। যত বেশি পর্যবেক্ষক আসবে, তত নির্বাচন স্বচ্ছ হবে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ সময়ের আলোকে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে পর্যবেক্ষকের খুব একটা কানেকশন থাকার কথা না। তারা দেখবে আর রিপোর্ট করবে। এমন না যে তারা থাকলে কেউ কিছু করতে পারবে না। এই পর্যবেক্ষকদের চেয়ে আমাদের মিডিয়া আরও বেশি অ্যাক্টিভ। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এসে কোনো কাজ খুব এগিয়ে দেবে বা এ নির্বাচন সুন্দর করাবে বলে আমি মনে করি না। বরং আমি মনে করি যে, আমাদের যে মিডিয়া আছে তারা দায়িত্ব পালন করলে সুন্দর নির্বাচন হবে।

অনেক দেশে পর্যবেক্ষক আসতেই দেয় না। আমাদের পাশের দেশ ইন্ডিয়ায় কোনো পর্যবেক্ষককে আসতেই দেওয়া হয় না। আমাদের দেশের ব্যাপারে বিদেশিদের কৌতূহল অনেক বেশি। এই কৌতূহল দেখানোর কোনো কারণ নেই-আমাদের দেশের নির্বাচন আমরাই করব। তাদের যে আসতেই হবে এর কোনো কারণ দেখি না। ইইউ বলছে.তাদের বাজেট স্বল্পতার কারণে তারা আসতে পারবে না। এটা তাদের ব্যাপার।

নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে ইইউর বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা একটা আশ্চর্যের ব্যাপার। আমাদের নির্বাচন হতে এখনও তিন সাড়ে তিন মাস বাকি আছে, ওনারা এখনই পরিবেশ দেখে ফেলছেন। এখনও চূড়ান্ত কোনো পর্যায়ে যায়নি। এই অ্যাডভান্স চিন্তা করাটা সন্দেহের একটা বিষয়। তারা এত আগে চিন্তা করছে কেন? নির্বাচনে অনেক কথাই শেষ পর্যন্ত হয়। তিনমাস, সাড়ে তিন মাস আগে তারা ধারণাই করে ফেলল যে-নির্বাচন ভালো হবে না। তাদের এই পর্যবেক্ষণ সন্দেহজনক।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র অত্যন্ত দুর্বল যে কারণে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দরকার হয়। স্বাধীনতার পর থেকে নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এমনকি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সরকারের কার্যক্রমও প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু সরকার ও নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতার যে অভাবটা রয়েছে সেটা বৃদ্ধি করার জন্য পর্যবেক্ষক দরকার।

তারা ভালো সার্টিফিকেট দিলে আমরা ভালো হয়ে যাব। আর খারাপ সার্টিফিকেট দিলে খারাপ হয়ে যাব। একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জন্য পর্যবেক্ষদের সার্টিফিকেট নিয়ে গ্রহণযোগ্যতা মাপা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য লজ্জাজনক।

তিনি আরও বলেন, পর্যবেক্ষকদের সামনে তো চুরি করা যায় না, আত্মসম্মানে বাধে। এ জন্য পর্যবেক্ষকদের প্রভাব তো থাকেই। তারা যদি রিপোর্ট দেয় আর সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে যদি আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বয়কট করে দেয় তা হলে তো ঝামেলা হবে।

যারা চুরি করে ক্ষমতায় আসবে তাদের দেশ চালাতে অসুবিধা হবে। এসব কারণের জন্য পর্যবেক্ষক না এলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটু সমস্যা হবেই। আইনে আছে, বিদেশি পর্যবেক্ষরা এলে নির্বাচন কমিশন পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করবে আর যদি না আসে তা হলে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না-এসবের কোনো বালাই নেই।

এখানে সরকারের গ্রহণযোগ্যতার জন্য ছোট পরিসরে হলেও পাঠানোর আহ্বান করা হচ্ছে। তবে পর্যবেক্ষক না এলে গ্রহণযোগ্যতা ছাড়া কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা নয়। না আসার পেছনে সরকার ও ইসির উভয়ের ব্যর্থতা আছে। তারা (ইইউ) পরিবেশের কথা বলেছে। পরিবেশ ঠিক করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার করেনি বলে তারা না করে দিচ্ছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইইউর পাঁচ-ছয়জন লোক দুই সপ্তাহের মতো এ দেশে থেকে তন্ন তন্ন করে তদন্ত করল, খোঁজখবর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিল এবং আগেই বলা হয়েছে তারা যে সুপারিশ করবে সে অনুযায়ী ইইউ সিদ্বান্ত নেবে। সুতরাং তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পাঠাবে না। এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ বিরাজ করছে না। আমরা বহুদিন থেকে বলে আসছি, ইইউ বলল, আমেরিকানরা ভিসানীতি প্রয়োগ করল, সবাই বলছে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। এরপরও নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের আয়োজন করে। এতেই তো প্রমাণ করে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। যারা ক্ষমতায় আছে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য আরেকটা নির্বাচন করতে চায়।

এই দায় নির্বাচন ও সরকার দুজনেরই। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েই তো প্রশ্ন আছে। তাদের প্রতি আস্থাহীনতা আছে। সরকার সম্পূর্ণ অসাংবিধানিকভাবে পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। সবাই তো এর জন্য দায়ী। নির্বাচন কমিশন যদি নিরপেক্ষ হতো তা হলে বলত বর্তমান কাঠামো এবং পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই।

আরও খবর