রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন প্রায় চূড়ান্ত : চলছে কুটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ

ডেস্ক রিপোর্ট •

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের আলোচনা নতুন করে সামনে এলেও এ বিষয়ে মিয়ানমারের সদিচ্ছা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বৈশ্বিক চাপ মোকাবিলায় এটি মিয়ানমারের লোক দেখানো উদ্যোগ হতে পারে। কারণ অতীতেও এমন উদ্যোগ নিয়ে নানা টালবাহানায় পিছিয়ে গেছে নেপিডো।

চীনের মধ্যস্থতায় আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার আগামী দুই মাসের মধ্যেই তিন হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরাতে একমত হয়েছে।

গত সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে দুই দেশের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে আস্থা তৈরির পদক্ষেপের বিষয়ে দুই দেশের কর্মকর্তারা কথা বলেন।

দীর্ঘদিন পর এবার হয়তো প্রত্যাবাসন আলোর মুখ দেখবে- এমন আশার কথা দুই দেশের সরকারি পর্যায় থেকে বলা হলেও রোডম্যাপহীন প্রত্যাবাসন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা একেবারেই উচিত হবে না।

চীনের কারণে তারা অল্প কয়েকজনকে ফেরত নিয়ে একদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের পাবলিসিটি বাড়াবে, অন্যদিকে চীন তোষণনীতি অব্যাহত রাখবে। আর বাকি লাখ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বইতে হবে বাংলাদেশকেই। এজন্য প্রয়োজন চীনের মধ্যস্থতায় সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ।

সেই রোডম্যাপে স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে- কখন কীভাবে কতজনকে ফেরত নেবে তারা। আর এটি না করতে পারলে বরাবরের মতো ঝুলে যাবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া।

প্রত্যাবাসন নিয়ে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ-মিয়ানমার এমওইউ স্বাক্ষর হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা পদ্মায় অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক এবং মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব ইউ মিন্ট থু নিজ নিজ পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী। ওই চুক্তির আওতায় মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে ফেরত পাঠানোর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি) গঠন করা হয়।

চুক্তি অনুযায়ী, জেডব্লিউজি রোহিঙ্গাদের ফেরার বাস্তব উদ্যোগ নেবে। এর মধ্যে রয়েছে- যাচাই প্রক্রিয়া, সময়সূচি, পরিবহন, আনুষঙ্গিক আয়োজন, অভ্যর্থনা প্রক্রিয়া, নির্ধারিত মেয়াদকালে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য যোগাযোগ।

জেডব্লিউজি গোটা প্রক্রিয়া মূল্যায়ন করবে এবং প্রতি তিন মাসে নিজ সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করবে। জেডব্লিউজি চুক্তি স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু নিশ্চিত করবে। এরপর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে।

জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে একাধিকবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে জোরালো আওয়াজ তুলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু কথা রাখেনি মিয়ানমার।

সবশেষ গত এপ্রিল মাসে চীনের কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে মোট ৭ হাজার ১৭৬ রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফিরিয়ে নেয়া হবে। এপ্রিলে নেয়া সিদ্ধান্ত গত সাড়ে তিন মাসেও বাস্তবায়ন করা যায়নি।

এখন বাংলাদেশ সরকার চাইছে, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ছোট একটি দলকে রাখাইনে পাঠিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে হলেও প্রত্যাবাসন শুরু হোক। এ বিষয়ে চীন তাগাদা দিচ্ছে বাংলাদেশকে।

এখন আগামী দুই মাসের মধ্যে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে নিয়ে রাখাইনে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু এতেও সংশয় প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, মিয়ানমারের কোনো কথাতেই আমি আশাবাদী নই। এদের কোনো কথার অর্থ নেই। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ তারা করেনি। সুস্পষ্ট চুক্তি না হলে এদের বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।

তিনি বলেন, ওরা ২০১৭ সালেও বলেছিল ফেরত নেবে। তখন রাজধানী ঢাকার পদ্মায় এমওইউ স্বাক্ষর পর্যন্ত হয়েছিল। রেজাল্ট কী হলো? বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীও তখন ওখানে গিয়েছিলেন এবং সাইন করেছিলেন। কিন্তু কিচ্ছু হয়নি। কারণ ওরা সৎ নয়। ওরা টোটালি ডিজঅনেস্ট।

বিশ্লেষকদের মতে, রাখাইনে প্রত্যাবাসনের জন্য এখনো সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়নি। তবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ কখনো দ্বিপক্ষীয়, কখনো চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে গেছে।

কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তারিখ ঘোষণার পরও দুই দফায় প্রত্যাবাসনের চেষ্টা বিফলে গেছে। আবার ২০২১ সালে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়।

অন্যদিকে ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে দুই দফায় মাত্র ৩ হাজার জন রোহিঙ্গা ফেরত নিলে বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবে না বলে মনে করছেন তারা, বরং বাংলাদেশের জন্য বুমেরাং হতে পারে। কারণ সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না থাকলে মিয়ানমার এরপর আর কাউকেই ফেরত নেবে না। তখন বাংলাদেশও আওয়াজ তুলতে পারবে না।

এ ব্যাপারে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, চীনের এই উদ্যোগে ৭ হাজার ফেরত নেয়ার কথা ছিল। ৭ হাজার নিলে ১১ লাখের মধ্যে হতো শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু সেখান থেকে পেছনে এসেও তারা বলছে, দুই দফায় ৩ হাজার জনের কথা। বাচ্চাই তো এর চেয়ে বেশি জন্ম নেবে। এই ৩ হাজার জন ফেরত গেলে বাংলাদেশের কী লাভ হবে? যদিও আমি নিশ্চিত নই যে, তারা যাবে। আর তাদের জোর করে পাঠানো যাবে না।

অন্যদিকে মিয়ানমারে নিশ্চয়ই এমন কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি যে, রোহিঙ্গারা যাবে। সেখানে একটা গৃহযুদ্ধ চলছে। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের পছন্দ করে না। কোথায় নিয়ে যাবে? মংডুতে নেয়ার কথা বলছে। সেখানে নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো ক্যাম্পে রাখবে।

সেটি কি বাংলাদেশ থেকে ভালো? তফাৎ কী? তাহলে কি রোহিঙ্গারা যাবে? যদি যায়ও তাহলে এই ৩ হাজার গেলে আমাদের কিছুই যায় আসে না। আমাদের কোনো লাভ নেই, বরং মিয়ানমার পাবলিসিটির চান্স পাবে। আর চীনকে খুশি করা হবে।

সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশের উচিত চীনকে বলা, একটা রোডম্যাপ দাও- কীভাবে ওরা ফেরত যাবে। কারণ ২০ হাজারের লিস্ট দেয়া হবে আর ওরা বলবে আমরা আগে ৫ হাজার নেব, এসব বলে সমস্যার সমাধান হবে না। কোনো পক্ষেরই লাভ হবে না।

উল্লেখ্য, সর্বপ্রথম ১৯৭৮ সালে দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ-মায়ানমারের সীমান্ত জেলা কক্সবাজারে আসে। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের শিকার হয়ে কক্সবাজারে আসে আরো ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। এরপর ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত হামলা গণহত্যা চালানোর পর কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আসে আরো সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। এদের সাথে আগে থাকা উল্লিখিতরা মিলে কক্সবাজার জেলা এখন ১২ লাখ রেহিঙ্গা শরণার্থীর আবাসভূমি। এদের ছয় লাখ এখন আছে শরণার্থীদের জন্য নির্মিত কুতুপালং মেগা শিবিরে। আর এটি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির।

আরও খবর