মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প: আরো কাটা পড়বে পাহাড় বন

বণিক বার্তা •

কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়কের ভাঙন রোধে রাস্তাটি আরো প্রশস্ত করার জন্য একটি প্রকল্প নিয়েছে সেতু ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। গত বছরের জুনে এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পাস হয়।

প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সড়কটি প্রশস্ত করা হলে প্রকল্প এলাকায় আরো গাছ ও পাহাড়ি বন কাটা পড়বে বলে জানিয়েছেন মেরিন ড্রাইভের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে গবেষণাসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, এর ফলে হুমকির মুখে পড়বে সামুদ্রিক কাছিম ও লাল কাঁকড়ার আবাস। ব্যাহত হবে এ অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্য। সড়ক প্রশস্ত করে নয় বরং ভাঙন রোধে বিজ্ঞানসম্মত অবকাঠামো নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

পর্যটন শিল্পের বিকাশে ২০০৮ সালে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ শুরু হয়। প্রথম পর্বে কলাতলী থেকে ইনানী পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হয়। দ্বিতীয় পর্বে ২০১৬ সালে ইনানী থেকে শিলখালি পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার এবং তৃতীয় পর্বে শিলখালি থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হয় ২০১৮ সালে। সড়কটি পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু গত বছর হঠাৎ করেই সড়কটিতে ভাঙন শুরু হয়, চলতি বছরে যা তীব্র আকার ধারণ করে।

মেরিন ড্রাইভ সড়কের ভাঙন রোধে গত বছর ‘কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্তকরণ’ প্রকল্প হাতে নেয় সড়ক বিভাগ। প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, প্রথম ধাপে ১ হাজার ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে উখিয়া উপজেলার পাটুয়ারটেক পর্যন্ত ৩০ দশমিক ৪০ কিলোমিটার রাস্তা প্রশস্ত করা হবে। এছাড়া রেজুখালের ওপর নির্মাণ করা হবে ৩০৫ মিটারের দুই লেনের সেতু।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও টেকনাফের নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং প্রকল্প এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২৫ সালের জুন পর্যন্ত।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক প্রশস্ত করতে গেলে কক্সবাজারের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়কের দুই পাশে কয়েক লাখ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। মেরিন ড্রাইভের তীরঘেঁষেই রয়েছে সমুদ্রসৈকতের লাল কাঁকড়া, কচ্ছপ, ডলফিন ও সাগরলতাসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাঁচটি নির্ধারিত স্থান। এছাড়া রয়েছে পাহাড় ও পাহাড়ি বন। তারা বলছেন, সড়কটি প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের সার্বিক পরিবেশ ও প্রাণীদের আবাস ক্ষতির মুখে পড়বে।

সরজমিন দেখা যায়, মেরিন ড্রাইভ সড়কের দরিয়ানগর থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত রাস্তার গা ঘেঁষেই দুই পাশে রয়েছে ছোট-বড় পাহাড় ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এ সড়ক প্রশস্ত করতে গেলে কক্সবাজার থেকে ইনানী পর্যন্ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গাছ কেটে ফেলতে হবে। এখানকার বেশ কয়েকটি স্থানে রয়েছে লাল কাঁকড়া ও সামুদ্রিক কাছিমের অবাধ বিচরণস্থল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এসব প্রাণের আবাস।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামুদ্রিক ঢেউয়ে সড়কের ভাঙন ঠেকানোর জন্য রাস্তা প্রশস্ত করা কোনো সমাধান নয়, বরং সড়কের ডিজাইন এমনভাবে করা উচিত যাতে ঢেউয়ের কারণে সড়ক না ভাঙে। সড়ক নির্মাণে কোনোভাবেই পাহাড়ি বন বা পাহাড় কাটা সমর্থনযোগ্য নয় বলে জানান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘প্রশস্ত করে মেরিন ড্রাইভ সড়কের ভাঙন ঠেকানো সম্ভব নয়। সেখানে সামুদ্রিক ঢেউয়ের পাশাপাশি পাহাড়ি স্রোতও আসে। তাই সড়ক বড় করে সেখানে বিপর্যয় আরো বাড়ানো হবে।’

তিনি বলেন, ‘৩০ বছর আগেও এ অঞ্চলে ছিল প্রাকৃতিক দ্বীপ। সমুদ্রঘেঁষে পাহাড় থাকার ফলে পাহাড়ের পাদদেশ ক্ষয়ে ক্ষয়ে সেখানে তৈরি হয়ে পাহাড়ি ক্লিপ। পৃথিবীর যেখানেই সমুদ্রের পাশে পাহাড় আছে সেখানেই এ ধরনের ন্যাচারাল ক্লিপের দেখা মেলে। সমুদ্র ও পাহাড়ের মেলবন্ধনে এটি একটি চমৎকার ইকোসিস্টেম। পাহাড় ও সমুদ্রের মাঝে ইকোসিস্টেমের লিংক রয়েছে। এ লিংক কোস্টাল এরিয়ার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেরিন ড্রাইভ করার ফলে ওই লিংকেজ বা সংযোগ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন নতুন করে যদি আবার সড়কটি প্রশস্ত করা হয় তাহলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে। এতে একদিকে পাহাড় কাটা পড়বে, অন্যদিকে সমুদ্রপাড় ভরাট হবে। কাছিমসহ সামুদ্রিক প্রাণীর আবাস হুমকিতে পড়বে। ব্যাহত হবে সামুদ্রিক কাছিমের প্রজননও।’

একই কথা বলেছেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান।

তিনি বলেন, ‘দুবাইসহ বিশ্বের অনেক শহরেই কিন্তু সমুদ্রের পাশে স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে। সেখানে এমনভাবে সড়ক ডিজাইন করা হয়েছে যাতে ঢেউ সড়ক অবকাঠামোয় আঘাত লাগার আগেই সেটার শক্তি কমে যায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে। মেরিন ড্রাইভ সড়কের ভাঙন রোধে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। সড়ক প্রশস্ত করে ভাঙন ঠেকানো যাবে না, বরং এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হবে। পাশাপাশি কক্সবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।’

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১১৩ দশমিক ২৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। এছাড়া ৭ লাখ ২৪ হাজার ঘনমিটার মাটি ভরাট, ২৯ দশমিক ৪২ কিলোমিটার ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট প্রশস্তকরণ ও দশমিক ৩২ কিলোমিটার ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট বাঁক সরলীকরণ কাজ করা হবে। নির্মাণকাজের মধ্যে ৬ হাজার ৪৮০ মিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল, ৬৩ হাজার ৭২০ বর্গমিটার জিও টেক্সটাইলসহ সিসি ব্লক স্থাপন, ৫৪ হাজার ৩৬০টি টেট্রাপড নির্মাণ, ৯ হাজার ১২০ বর্গমিটার রোড মার্কিং, ইউটিলিটি স্থানান্তর, পানি নিষ্কাশনে ৯ হাজার ১৮০ মিটার এল ড্রেন ও ১৩ হাজার ৯৪ মিটার ইউ ড্রেন নির্মাণ করা হবে।

মেরিন ড্রাইভ সড়ক পর্যটককে বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু হলেও পরিবেশ ধ্বংস করে এবং পাহাড় ও বন কেটে সড়ক প্রশস্তের এ প্রকল্পের কারণে এখানকার প্রতিবেশে চরম বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

তিনি বলেন, ‘মেরিন ড্রাইভ অবশ্যই পর্যটক আকর্ষণের জায়গা। কিন্তু এটি যেভাবে নির্মিত হয়েছে, বারবারই দেখা যাচ্ছে এটা ভাঙনের কবলে পড়ছে এবং বারবারই নতুন করে বানানো হচ্ছে। তার মানে এ সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সঠিকভাবে করা হয়নি। কক্সবাজারে একটা পাহাড়ের গায়ে আর কোপ দেয়ার কোনো উপায় নেই। এরই মধ্যে এ অঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ পাহাড় ও বন চলে গেছে। নতুন করে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলে মেরিন ড্রাইভ প্রশস্ত হোক এটা নিশ্চয় পর্যটকরা চায় না। এ প্রকল্পের বিস্তারিত জনগণের সামনে তুলে ধরে জনমত যাচাই করে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে, বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে, বন বিভাগের মতামত নিয়ে তার পরই চূড়ান্ত পরিকল্পনা করতে হবে। কোনো একক সংস্থা এভাবে বারবার প্রকল্প নেবে, জনগণের টাকায় সে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে, সে প্রকল্প আবার ভাঙবে, আমরা আবার টাকা দেব—এমন খেলা কোনো আইনসিদ্ধ হতে পারে না।’

সমুদ্র ও পাহাড়বেষ্টিত এ জায়গাটাকে পরিবেশবিদরা ইকোলজিক্যাল হটস্পট হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। যদিও মেরিন ড্রাইভ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনবে, এমনটা বলা হয়েছিল কিন্তু নির্মাণের পর এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ সমৃদ্ধি এনেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশবিশেষজ্ঞরা। সড়ক প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে পাহাড় কাটা হলে ধীরে ধীরে পাহাড় ক্ষয় ও ধসের শঙ্কা তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ গবেষকরা।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘আগের বার যখন মেরিন ড্রাইভ করা হয়েছিল, তখন এখানে হাজার হাজার গাছ কাটা হয়। উপকূলীয় অঞ্চলে যদি এভাবে গাছ কেটে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো করি, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলীয় পরিবেশ। মেরিন ড্রাইভ সড়ক করার পর পরই এটি ব্যাপক ভাঙনের কবলে পড়ে। এখন যদি রাস্তা প্রশস্ত করার নামে আবার গাছ কাটা হয়, পাহাড় কাটা হয়, তাহলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা কীভাবে সম্ভব হবে? জলবায়ু পরিবর্তনের এমন কঠিন সময়ে এ ধরনের প্রকল্প কখনোই সুফল বয়ে আনবে না।’

তিনি বলেন, ‘ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। রাস্তা প্রশস্ত করে ভাঙন ঠেকানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যদি আধুনিক কোনো সিভিল স্থাপনা করার প্রকল্প নেয়া হতো তাহলে এটা মেনে নেয়া যেত। কিন্তু ভাঙা রাস্তা চওড়া করে সংশ্লিষ্টরা কাকে সুবিধা দিতে চাচ্ছেন? জনগণের টাকা অপচয় করে এ ধরনের দুর্বল স্থাপনা নির্মাণের কোনো মানে হতে পারে না।’

তবে ভিন্ন কথা বলছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্ত হচ্ছে। আমরা এমনভাবেই সড়ক প্রশস্ত করব যেন এখানে কোনো ভাঙন না হয়। পরিবেশের বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় থাকবে।’

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘পাহাড়-বন তথা পরিবেশ আমাদের কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ। মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্তের ক্ষেত্রেও আমরা পরিবেশগত বিষয়টি বিবেচনায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের বলব।

আরও খবর