বিশেষ প্রতিবেদক :
২০১০ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন হওয়ার সময় চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা।
তবে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই ২০১৬ সালে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন শেষে প্রকল্প ব্যয় এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ নির্মাণ শুরুর আগেই প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায় ১০ গুণ অর্থাৎ ১৬ হাজার ১৮২ কোটি টাকা বা ৮৭৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যয় বাড়ানোর পরও এই প্রকল্পে নিম্নমানের কাজ ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
যথাসময়ে কাজ শেষ করা এবং প্রকল্প ব্যয় না বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা থাকলেও মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে ১০ গুণ ব্যয় বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক আখ্যা দিয়ে পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে অর্থ আত্মসাতের জন্যই বারবার বিভিন্ন প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর ঘটনা ঘটছে। এর সঙ্গে রেলওয়ে ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি সিন্ডিকেট জড়িত বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে প্রকল্প গ্রহণের আগে মাঠ পর্যায়ে সঠিক সমীক্ষা না করারও। তবে রেলওয়ের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, জমি অধিগ্রহণ ব্যয় বৃদ্ধি এবং ডাবল লাইন ও ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণের কারণে ব্যয় বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ১৫৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রকল্পটির রামু-ঘুমধুম অংশের সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় ধরা আছে ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পটির প্রথম অংশের দুই প্যাকেজের ঠিকাদার নিয়োগ করা হলেও কাজ শুরু হয় পরের বছর।
এর মধ্যে দোহাজারী-চকরিয়া পর্যন্ত প্রথম প্যাকেজ যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন। এ অংশের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের জুলাইয়ে। আর চকরিয়া-রামু-কক্সবাজার অংশের দ্বিতীয় প্যাকেজে যৌথভাবে কাজ করছে চায়না সার্টিফিকেশন অ্যান্ড ইন্সপেকশন কোম্পানি (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এ অংশের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের মার্চে। দেশীয় প্রভাবশালী এ দুটি প্রতিষ্ঠানই রেলওয়ের বেশিরভাগ বড় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সম্প্রতি ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে নির্মাণাধীন রেললাইনের একটি অংশে পাথর ও মাটি ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি রেললাইন উঁচু-নিচু ও বাঁকা হয়ে যায়। এতে রেলপথ নির্মাণ ও সংস্কারে অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্পের নকশায় ত্রুটির কারণে পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় কক্সবাজারের রেলপথ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা ছাড়া তত্ত্বাবধান, রক্ষণাবেক্ষণ ও সঠিক উপকরণ সঠিকভাবে ব্যবহার না করার কারণে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্রিটিশ আমলে তৈরি রেললাইন বাঁকা হওয়ার কোনো খবর পাওয়া না গেলেও নতুন তৈরি করা লাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনায় প্রকল্পের নির্মাণ কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে প্রকল্পের ব্যয় ১০ গুণ বাড়ানোর পরও নিম্নমানের কাজ হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে এটা যেমন সত্য, এর চেয়ে অনেক বেশি সত্য হচ্ছে-উন্নয়নের নামে মেগা প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। প্রায় শতভাগ মেগা প্রকল্পেই দফায় দফায় মেয়াদ বৃদ্ধির পাশাপাশি বরাদ্দের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হচ্ছে। এটা শুধু রেলে নয়, সব ক্ষেত্রেই হচ্ছে।
আশীষ কুমার দে বলেন, রেলের ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা করার পেছনেও দুর্নীতির স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রকল্প পরিচালক ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ছাড়াও এর পেছনে রাঘববোয়ালরা জড়িত আছে। তা না হলে একটি প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় ৯০০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়বে এবং জনগণ উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হবে। তিনি বলেন, সড়ক কিংবা রেলের এ ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প চূড়ান্তকরণের আগে প্রতিবেশ ও পরিবেশগত দিক ভেবে দেখা উচিত; যাতে ভবিষ্যৎ বা নিকট ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয়। কিন্তু দৃশ্যত মনে হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও আখাউড়া রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে তেমন ভাবা হয়নি। রেলপথ নির্মাণের আগে যথাযথভাবে মাটি পরীক্ষা করা হয়নি।
ট্রেনের মতো অত্যন্ত ভারী ও দ্রুতগামী বাহন চলাচলের উপযোগী করা হয়নি। বরং এই রেলপথের নিচে থাকা খালসহ অন্যান্য জলাভূমি ঢালাওভাবে ভরাট করা হয়েছে। ফলে রেললাইন দেবে যাচ্ছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অতি উৎসাহী কিছু লোকের অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ এবং অপরিকল্পিত ভাবনা-চিন্তার কারণেই এমন বিপর্যয় হয়ে থাকে বলে মন্তব্য করেন আশীষ কুমার দে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের বিশদ নকশায়ও ভুল আছে। এ রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে পানি প্রবাহের বিপরীত মুখে। শুধু মাটি উঁচু করে রেলপথ বানানো হয়েছে এবং পানি যাওয়ার পর্যাপ্ত পথ রাখা হয়নি।
রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, শুধু দোহাজারী-কক্সবাজার প্রকল্প নয়, রেলওয়ের প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর বিষয়টি একরকম নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি সিন্ডিকেট ব্যয় বাড়িয়ে দেশি-বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বড় ধরনের সুবিধা নিয়ে থাকে। এ কারণে রেলের কোনো প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ে শেষ করা হয় না। আবার সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া ও ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ মাঠ পর্যায়ে সঠিক সমীক্ষা না হওয়া। রেলওয়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বিদেশি ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয় নির্ধারণের।
এমন অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুসন্ধান করে রেলওয়ের দুই প্রকল্প জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের নির্ধারণ করা ব্যয় ১৪ হাজার ৬২১ কোটি টাকা থেকে ৪০ শতাংশ এবং আখাউড়া-সিলেট সেকশনের মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা প্রকল্পের ১৬ হাজার ১০৪ কোটি টাকা থেকে ২০ শতাংশ কর্তন করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, কোনো প্রকল্পে কম ব্যয় ধরা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বাস্তবায়ন শুরু করতে দেরি করার পাশাপাশি ব্যয় বাড়ানোর উপায় খুঁজতে থাকেন। প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও পরামর্শকের শক্ত সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ পদক্ষেপ নিতে গেলে তাকে নানাভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় বলে একাধিক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
তারা জানান, প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা রেলওয়ের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অবসরে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে মোটা অঙ্কের বেতনে পরামর্শক হিসেবে চাকরি নিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের নিয়ম মানার জন্যই হয়তো আমাদের এখানে নামমাত্র সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষাকে সারা পৃথিবী উন্নয়নের দলিল হিসেবে মনে করলেও বাংলাদেশে এর পুরো উল্টো। আমাদের এখানে এমন একটা সংস্কৃতি তৈরি করেছে যে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই মানেই একটা প্রকল্প নিয়ে আসা। কারণ যারা এমন সমীক্ষা করেন তারা জানেন, পরবর্তী সময়ে এটা কেউ খুঁজবে না। এসব কারণে প্রকল্পের মেয়াদের সঙ্গে ব্যয়ও বাড়ে।
অস্বাভাবিক ব্যয় কেন বাড়ল জানতে চাইলে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান বলেন, আমার কাজ হচ্ছে যথাযথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। ব্যয় কেন বাড়ল তা রেলওয়ের পরিকল্পনা বিভাগ ভালো বলতে পারবে। তিনি এ বিষয়ে রেলওয়ের পরিকল্পনা বিভাগের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিম উল্লাহ বাহার বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে একটা লামছাম (আনুমানিক) হিসাব ধরে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পটির প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করে ব্যয়ের বিষয়টি আপডেট করা হয়। তা ছাড়া জমির মূল্য বেড়েছে এবং অধিগ্রহণ করলে তিনগুণ টাকা দেওয়ার নিয়ম করায় কয়েক হাজার কোটি টাকা এখানেই বেড়েছে। এ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ার এ রকম অনেক কারণ রয়েছে বলে জানান তিনি।
রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান সময়ের আলোকে বলেন, ২০১০ সালে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করে একটা ডিপিপি তৈরি করা হয়েছিল। প্রকল্প ব্যয় যখন ১৮ হাজার কোটি টাকা হলো সেখানে জমির মূল্যই রয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। আর প্রথমে রেললাইন মিটারগেজ করার কথা থাকলেও পরবর্তী সময়ে এটাকে ডুয়েলগেজ করা হয়েছে এবং প্রস্তাবিত সিঙ্গেল লাইনকে পরে ডাবল লাইন করা হয়েছে। ডাবল লাইনের জন্য জমি বেশি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। এ ছাড়া ৭৫ পাউন্ডের রেলের পরিবর্তে ৬০ কেজি বা ১২০ পাউন্ড করা হয়েছে। এভাবে প্রকল্প ব্যয় ১৮ হাজার কোটি টাকা কেন হলো তা প্রকল্পের ডকুমেন্টে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে।
সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করেই রেলওয়ের সব প্রকল্প নেওয়া হয় জানিয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে রেলের প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পও সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করেই নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ ঠিক নয়। কারণ ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে মাত্র দুই থেকে তিন কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-