শূন্য থেকে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক টেকনাফের জাহাঙ্গীর

মুহাম্মদ আবুল কাশেম, যুগান্তর •

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত দেড় শতাধিক মাদক কারবারি আত্মসমর্পণের পরে থেমে নেই ইয়াবা, হুন্ডি, মানব পাচার ও অস্ত্র ব্যবসা। আত্মসমর্পণকারীদের অনেকে আবারও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদেরই একজন জাহাঙ্গীর আলম (৩০)।

তিনি টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদার বাসিন্দা। অভিযোগ আছে, কারাগার থেকে বের হয়ে আবার ইয়াবার বড় বড় চালান মিয়ানমার থেকে এনে দেশের বিভিন্নস্থানে পাঠাচ্ছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে একাধিক মাদক ও অস্ত্রসহ অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ সূত্র।

জানা গেছে, ১০ বছর আগে জাহাঙ্গীর বেকারত্বের কারণে অসহায় জীবনযাপন করতেন। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের পুঁজি করেই তিনি এখন আছেন রাজা-বাদশার মতো। মাদক ও চোরাচালানের অর্থে তিনি গড়ে তুলেছেন বিশাল সাম্রাজ্য। থাকেন অট্টালিকায়। চড়েন আলিশান গাড়িতে। স্থানীয়রা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করেই জাহাঙ্গীর হয়ে গেছেন টাকার কুমির। অঢেল সম্পদ ও অর্ধশত কোটি টাকার মালিক। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রাতের আঁধারে ইয়াবা এনে তিনি আজ এ বিত্তবৈভবের মালিক।

২০১১ সাল থেকে হঠাৎ তার উত্থান। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় বাড়ি হওয়ায় রাতের অন্ধকারে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় বস্তা ভর্তি ইয়াবা এনে অল্প দিনেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। ইয়াবাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে একাধিকবার আটক হলে কালো টাকার বিনিময়ে কারাগারে বেশি দিন থাকতে হয়নি। মামলা সূত্রে জানা যায়, জাহাঙ্গীর ছাড়াও তার বড় ভাই জাফরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি। তিনি ২০১৯ সালে মাদক ও অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে গিয়েছিলেন। এখন আবার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে, লেদা এলাকায় প্রায় এক বিঘা জমির উপরে বিদেশি স্টাইলে ডুপ্লেক্স বাড়ি তার। ভেতরের ডেকোরেশন পাঁচ তারকা হোটেলের মতো। এ ছাড়া হ্নীলা ও টেকনাফে বিভিন্ন ব্যাংকে স্ত্রীর-সন্তানের নামে রয়েছে কোটি টাকার এফডিআর। প্রতিবেদকের কাছে তথ্য সংরক্ষিত আছে।

এছাড়া চট্টগ্রামের রাহাত্তারপুল এলাকায় ৫তলা ভবন, লেদায় স্টেশনে কোটি টাকা ব্যয়ে মার্কেট, ৮ বিঘা জমির ওপর কোটি টাকা ব্যয়ে খেলার স্টেডিয়াম, মরিচ্যা ও লেদায় পাঁচ কোটি টাকার ইট ভাটার ব্রিকস ফিল্ড রয়েছে। লেদা ও হ্নীলা শ্বশুরবাড়ি এলাকায় রয়েছে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের ২০ বিঘা ফসলি জমি। এছাড়া ইয়াবা পাচারের জন্য কাভার্ডভ্যান, পাহাড় কাটার দুটি ডাম্পারসহ অর্ধ শতকোটি টাকার সম্পদের গড়েছেন এ মাদক কারবারি।

সূত্র বলছে, ইয়াবা চালানের কোটি কোটি টাকাও জাহাঙ্গীর আলমের মাধ্যমে মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে। ব্যাংক লেনদেনে ঝুঁকি থাকায় হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করে থাকে চোরাচালানকারীরা। কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ীরা নিরাপদ মাধ্যম হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে হুন্ডি করছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজারে বর্তমানে ২০ থেকে ২৫টি দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। প্রত্যেক চক্রে ২০ থেকে ৩০ সদস্য রয়েছেন। যারা মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর যেতে চায় এ চক্রের সদস্যরা প্রথমে তাদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৩০ হাজার টাকা নেন। ওই টাকার বড় অংশ স্থানীয় চক্রকে দেন। কিছু টাকা দিয়ে ট্রলার কেনেন। এরপর সবকিছু ঠিক করে মাথাপিছু আরও ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা নেন। এরপর ট্রলারে কিছু শুকনো খাবার তুলে দিয়ে পাড়ি দেয় সাগরপথে। সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ মানব পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হলেও পাচারকারী চক্রের বিস্তৃতি রয়েছে টেকনাফের সাবরাং, শামলাপুর ও মহেশখালী পর্যন্ত। টেকনাফে পাচারকারী চক্রের অন্যতম ঘাঁটি তিনটি-সাবরাং, জাহাজপুরা ও শামলাপুর।

মহেশখালীতে কুতুবজোম ইউনিয়ন। টেকনাফের সাবরাংয়ের মূল নিয়ন্ত্রক হলো জাহাঙ্গীরের সিন্ডিকেট। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল দিয়ে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর কাজে জড়িত অন্তত ৫০০ দালালকে তারা চিহ্নিত করেছে। মূলত রোহিঙ্গাদের ঘিরেই এ চক্রটি বেশি সক্রিয়। রোহিঙ্গাদের মাদক বিক্রির টাকাই মূলত দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছেন বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম মোবাইল ফোনে বলেন, আমি এখন আর ইয়াবা ব্যবসা করি না। সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এসব কিছুর আয়কর দেন বলে জানান। অল্প সময়ে এত সম্পদ, মানব পাচার ও হুন্ডি ব্যবসা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে শাসিয়ে বলেন, এসব বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে আপনার সমস্যা হবে। এরপর তিনি ফোনের সংযোগ বিছিন্ন করে দেন।

কক্সবাজার পুলিশ সুপার মাহাফুজুল ইসলাম জানান, আত্মসমর্পণের পর জাহাঙ্গীরসহ যারা আবার ইয়াবা ব্যবসা শুরু করছেন সবাইকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এসব বিষয়ে জেলা পুলিশ কাজ করছে। মাদকের বিরুদ্ধে কারও বিষয়ে ছাড় নেই।

আরও খবর