সুজাউদ্দিন রুবেল •
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে প্রায় এক’শো শিশু। এরই মধ্যে গেলো ৬ বছরে জন্ম নিয়েছে ২ লাখের কাছাকাছি। ক্যাম্পে দায়িত্বরত স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, রেশন বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্যাম্প জীবনে বিনোদন না থাকায় রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অন্যতম কারণ। আর রোহিঙ্গদের উর্ধ্বমুখী জন্মহার যেমন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তেমনি বড় সংকট তৈরি করছে। তবে উর্ধ্বমুখী জন্মহার নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে ৯০ এর দশকেও অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। সবমিলিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বসবাস করছে প্রায় ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গা।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, আশ্রয়শিবিরগুলোতে মোট পরিবার রয়েছে প্রায় ২ লাখের মতো। এর মধ্যে ৩ শতাংশ পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১০ জনের বেশি। ১০ শতাংশ পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৮ থেকে ৯ জন। ২৩ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৬ থেকে ৭ জন। ২৮ শতাংশ পরিবারে সদস্যসংখ্যা ১ থেকে ৩ জন। গড়ে প্রতি পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৫। আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৫২ শতাংশই শিশু। তাদের বয়স শূন্য থেকে ১৭ বছর।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোর বেশির ভাগ উখিয়ার কুতুপালংয়ে। যেটিকে বলা হচ্ছে বিশে^র সবচেয়ে বৃহৎ আশ্রয়শিবির। যেখানে ছোট একটি এলাকার মধ্যে ৭ লাখ বেশি রোহিঙ্গার বসবাস।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা নুর কবির। ৭ সন্তান ও স্ত্রীসহ ৯ জনের পরিবার নিয়ে নুর কবির গত ৬ বছর ধরে বসবাস করছেন ক্যাম্পের ডি-৫ ব্লকে। বড় ছেলের বয়স ১৮ বছর আর ছোট মেয়ের বয়স ৩ বছর।
নুর কবির বলেন, ৭ জন সন্তানের মধ্যে ৪ জন ছেলে ৩ জন মেয়ে। এখন যদি সামনে আল্লাহ আরও দেয় তাহলে বাচ্চা আরও নেব।
শুধু নুর কবির নন, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে বসবাস করা রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে বেশিভাগের সন্তান সংখ্যা ৪ জনের বেশি। এমনকি যাদের পরিবারে ৫ থেকে ৬ জনের বেশি সন্তান রয়েছে তারা আরও সন্তান নিতে আগ্রহী।
কুতুপালংস্থ ক্যাম্প ২ ইস্টের বাসিন্দা খায়রুল আমিন বলেন, মিয়ানমারের ওপারে আমার কোন বাচ্চা ছিল না। বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে ৬ বছরর বেশি হচ্ছে। এই ক্যাম্প জন্ম নিয়েছে ৪ টি বাচ্চা। আর বাচ্চা দেয়া না দেয়া এটা আল্লাহ’র ওপর। মন চাইলে নিব, মন না চাইলে আর নিব না।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয় জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে প্রায় এক’শো শিশু। এরই মধ্যে গেলো ৬ বছরে জন্ম নিয়েছে ২ লাখের কাছাকাছি। ক্যাম্পে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, পরিবার-পরিকল্পনা সম্পর্কে অনাগ্রহ, রেশন বৃদ্ধি ও ক্যাম্প জীবনে তেমন কোন বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় বেশি সন্তান জন্মদানের মূল কারণ।
উখিয়ার কুতুপালংস্থ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মিডওয়াইফ সুপারভাইজার আসমা আকতার বলেন, আরটিএমআই ইউএনএফপিএ’র অধীনে পরিচালিত প্রজেক্টে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাঠ পর্যায়ে কাজ করি।
রোহিঙ্গারা দীর্ঘমেয়াদি যে পদ্ধতি রয়েছে এটা নিতে একদম আগ্রহ নেই। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে স্ত্রী-স্বামী ও শাশুড়ীকে এনে কাউন্সেলিং করি। রোহিঙ্গারা পিল, কনডম ও ডিপু গুলো নিতে চাই। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ৩, ৫ বা ১০ বছরের যে পদ্ধতিগুলো একদম নিতে চাই না। কারণ রোহিঙ্গারা মনে করে, বাচ্চা যত বেশি জন্ম নিবে মাথাপিছু রেশন তত বেশি হবে। এজন্য রোহিঙ্গারা জন্মদানে বেশি আগ্রহী। এছাড়াও তাদের মাঝে নানা ধরণের কু-সংস্কার কাজ করে।
একই ক্যাম্পের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডা: ফাতেমা আকতার বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাচ্চা জন্মদানের প্রবণতা অনেক বেশি। কারণ তাদের কোন কাজ নেই। যেহেতু কোন কাজ নেই সেহেতু তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা হচ্ছে বাচ্চা নেয়া।
ডা: ফাতেমা আকতার আরও বলেন, মূলত আমরা ক্যাম্পে প্রসূতি মায়েরদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে থাকি। আমরা বেশি জোর লাগাচ্ছি, কাজ করছি মাঠ পর্যায়েও। আমরা মাঠ পর্যায়ে প্রতিটি পরিবারের কাছে গিয়ে পরিবার-পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে বুঝাচ্ছি এবং ডেমো প্রদর্শন করছি।
এদিকে কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৪ লাখের মতো। এখন ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। যা নতুন করে মাথাব্যথার কারণ হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের যদি কন্ট্রোল করা না যায় তাহলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া তো হয়েছে, কিছুদিন পরে এ সমস্যা আরও বড় আকার ধারণ করবে। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর পাশাপাশি তাদেরকে নিজদেশ মিয়ানমারে দ্রুত প্রত্যাবাসন করা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে বিশ^বাসীকে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, “যেভাবে রোহিঙ্গারা এসেছিল হাজার হাজার একসাথে, লাখে লাখে একসাথে; একই রকম করে এসব রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে দেখা যাবে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রোহিঙ্গা এখান থেকে যাচ্ছে কিন্তু তার বেশি চেয়ে রোহিঙ্গা শিশু ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্মহার বাংলাদেশিদের তুলনায় বেশি। এছাড়াও কক্সবাজারের চেয়েও বেশি বলা যায়। ক্যাম্পে গড়ে প্রতিদিন এক’শোর মতো শিশু জন্মগ্রহণ করছে। এটি আমাদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ যে, ঘনবসতি ক্যাম্পে রয়েছে; এখানে জায়গার সংকট রয়েছে। মাত্র ৮ হাজার একর জায়গার মধ্যে প্রায় ১০ লাখ লোক বাস করে। এখন নতুন নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করছে তাদের জন্য আমরা জায়গা কোথায় থেকে দিব। এটা একটা বড় সংকট।
কমিশনার মো. মিজানুর রহমান আরও বলেন, পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ও ইমামদেরকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতার কাজ করে যাচ্ছি।
প্রতিবছর আশ্রয়শিবিরে বাড়ছে জনসংখ্যা আর কমছে খাদ্য সহায়তা। সবমিলিয়ে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হলে নানামুখী সংকট যুক্ত হবে বলে শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-