বদলে যাচ্ছে কক্সবাজার

সুজাউদ্দিন রুবেল •

বদলের হাওয়া লেগেছে পর্যটন জেলা কক্সবাজারে। চলতি বছর জাতীয় গ্রিডে মিলবে মাতারবাড়ির বিদ্যুৎ, ট্রেন ছুটবে সৈকত শহরে, জ্বালানি তেল খালাসের আধুনিক পদ্ধতি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। এছাড়া গভীর সমুদ্র বন্দরসহ আরো কিছু বড় প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলছে বেশ জোরেসোরে।

নীতিনির্ধারকরা বলছেন, গত দেড় দশকে শতাধিক উন্নয়ন প্রকল্প ছাড়াও বর্তমান সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে বদলে গেছে স্থানীয়দের জীবনমান। এসব প্রকল্প কেবল কক্সবাজার নয়, বদলে দেবে দেশের অর্থনীতির গতিপথও।

সাগর-পাহাড়ের অপূর্ব মিতালী আর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বিস্ময়ভূমি এ কক্সবাজার। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত সমৃদ্ধ এ জেলা কেবল দেশেরই প্রধান পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি মুগ্ধ করছে ভিনদেশিদেরও। সব মিলিয়ে দেশের সর্বদক্ষিণ-পূর্বের এ জেলাকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে অর্থনৈতিক অগ্রগতির অপার সম্ভাবনা।

শুরুতেই আসা যাক, অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির প্রসঙ্গে। শেখ হাসিনা সরকারের ধারাবাহিক নানা পদক্ষেপে এ দুটির নিরবচ্ছিন্ন যোগান নিশ্চিতে বড় কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে কক্সবাজারের মাতারবাড়ি ও মহেশখালী।

এক দশক আগেও যা ছিলো পরিত্যক্ত ভূমি, কিংবা বড়জোর লবণ চাষের জলাভূমি, সেই মাতারবাড়ি এখন গড়ে দিচ্ছে অর্থনীতির শক্ত ভিত। সব ঠিক থাকলে চলতি বছরই এখানে ১,২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এ বিদ্যুৎ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে দেশের সবচেয়ে গভীর সমুদ্র বন্দর। এটি আমূল পাল্টে দেবে অর্থনীতির গতিধারা, যা ভূমিকা রাখবে সহজে এবং কম খরচে পণ্য পরিবহন ক্ষেত্রে; বাড়াবে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং দেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব।

কেবল তা-ই নয়, মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল সহায়ক ভূমিকা রাখছে জ্বালানি ঘাটতি পোষাতে। পরিকল্পনায় আছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির আরো কয়েকটি বৃহৎ প্রকল্প।

জ্বালানি তেল সঞ্চালনের ক্ষেত্রেও অত্যাধুনিক যুগে প্রবেশ করতে প্রায় শেষের পথে স্বপ্ন জাগানিয়া প্রকল্প সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম। অপচয় কমিয়ে কম সময়ে, কম খরচে তেল পরিবহনের এ পদ্ধতি বাড়তি মাত্রা যোগ করবে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে।

এসপিএম-এর প্রকল্প কর্মকর্তা মনজেদ আলী শান্ত বলেন, ‘যে তেল মহেশখালী অথবা কুতুবদিয়া থেকে চট্টগ্রাম নিতে আমাদের প্রায় ১০ থেকে ১২ দিন লাগতো, সেটা আমরা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিতে পারবো।’
এছাড়া পরিবেশবান্ধব উপায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে খুরুশকুলে গড়ে উঠছে ৬০ মেগাওয়াটের একটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র।

এতো গেলো বড় সব প্রকল্পের কথা। কিন্তু এসবের সুফল কতোটা মিললো মানুষের যাপিত জীবনে? দেশের বাকি এলাকার মতো কক্সবাজারেও শতভাগ মানুষের ঘরে এখন আলোর ঝলকানি। এমনকি সাবমেরিন ক্যাবলে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ কুতুবদিয়ায়ও, যা বদলে দিয়েছে স্থানীয়দের জীবনমান।
সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতেও গড়েছে অনন্য দৃষ্টান্ত। গৃহহীন মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে সারাদেশের আশ্রয়ণগুলোর মতো কক্সবাজারেও গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষায়িত ভবন। যেখানে মিলছে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা, যেনো গ্রামের মধ্যেই একখণ্ড শহর।
মানবিক বাংলাদেশের আরেক প্রতিচ্ছবি জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে খুরুশকুলের বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প।

এখানে আশ্রয় পাওয়া এক নারী বলেন, ‘কোনদিন কল্পনাও করিনি যে, তিনতলার ওপরে একটা ঘর পাবো।’

আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘আমাদের থাকার জন্য এতো চমৎকার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।’

খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল আফজাল হোসেন বলেন, ‘পুরো বিশ্বে কোথাও কিন্তু বহুতল আশ্রয়ণ প্রকল্প নেই। এটাও কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি অনন্য উদ্যোগ। উনি যে চিন্তা-ভাবনা করেছেন সেটা হয়তো আমরা করতে পরতাম না।’

অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বেশ এগুচ্ছে কক্সবাজার। যা ছিলো কেবলই স্বপ্ন, সৈকতের নগরে সেই রেলযাত্রা এখন ধরা দিচ্ছে বাস্তবে। আগামী অক্টোবর মাসেই পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন ছুটবে দেশের প্রথম আইকনিক রেলস্টেশন ঝিনুকের পানে।

সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের সুবাদে দৃষ্টিনন্দন রূপ পাওয়ার অপেক্ষায় কক্সবাজার বিমানবন্দর, বাড়ছে পরিসর, উন্নীত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরে। সাগরের জলরাশিতে থাকবে রানওয়ের এক প্রান্ত। সুনীল জল ছুঁয়ে উঠানামা করবে বিমান।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে, তার মাধ্যমে কক্সবাজারে অনেক বিজনেস হাব তৈরি হবে। এই হাবগুলোর ফলে কক্সবাজার কিন্তু বদলে যাবে। পর্যটনশিল্পকে আরো বিকশিত করতে গড়ে উঠেছে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর মোহাম্মদ নুরুল আবছার বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত কোস্টাল সিটির আদলে আমরা কক্সবাজারকে পরিবর্তন করতে চাই।’ পিছিয়ে নেই গ্রামীণ অবকাঠামোর ক্ষেত্রেও। পিচঢালা পথ সহজ করে তুলছে জনচলাচল, জীবনযাত্রা।

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, রাস্তাঘাট ভালো হওয়াতে পর্যটকও বাড়ছে। এতে আমাদের বেচাকেনাও বাড়ছে।’ তবে অবকাঠামো খাতেই নয়, ফসল উৎপাদনেও মিলছে বর্তমান সরকারের নানা উদ্যোগ, আর সহায়তার সুফল। তাইতো লবণ চাষ, মৎস্য চাষ কিংবা কৃষিজমিতে ফলন বাড়ানো – সবক্ষেত্রেই দেড় দশকে হয়েছে অভাবনীয় অগ্রগতি।

২০০৫-০৬ সালে কক্সবাজারে যেখানে ধানের উৎপাদন ছিলো ৩,৩৯,১০১ মেট্রিক টন, ২০২২-২৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪,৬৭,৫৫৭ মেট্রিক টনে। ২০০৬-০৭ মৌসুমে জেলায় লবণের চাষ হয় ১০.৫৪ লাখ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ মৌসুমে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২.৩৩ লাখ মেট্রিক টনে। আর মাছ ও শুঁটকির উৎপাদন ২০০৬-০৭ সালে ছিলো ১,৯৮,৫৫৬ মেট্রিক টন; ২০২২-২৩ এ হয়েছে ২,৯৫,৬৬৫ মেট্রিক টন।

সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এর গবেষণা বুনছে নতুন স্বপ্নের বীজ।

আরও খবর