শহরজুড়ে আতঙ্ক

ছিনতাই যেন কক্সবাজারের ‘ছোঁয়াচে রোগ’

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার •

কক্সবাজার শহরজুড়ে ছিনতাই আতঙ্ক বিরাজ করছে। শহরের প্রবেশদ্বার লিংকরোড়-বাস টার্মিনাল, বাইপাসসহ বিভিন্ন এলাকায় পেশাদার ছিনতাইকারীদের আনাগোনা চলে। প্রতিদিনই তাদের হাতে সর্বস্ব হারাচ্ছেন পর্যটক ও স্থানীয়রা। চাওয়া মাত্র মালামাল না দিলে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে প্রায়ই হতাহত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। এভাবে দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে ছিনতাইকারী চক্র।

চক্রের সদস্যরা দল-উপদলে ভাগ হয়ে করছে ছিনতাই। ভোর থেকে শুরু করে ভর দুপুর কিংবা সন্ধ্যার পর একাকি রাস্তায় বের হওয়া দুরূহ। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত হলেও পুলিশের পর্যাপ্ত টহল কিংবা বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকায় বেপরোয়া দুর্বৃত্তচক্র।

স্থানীয় ও ওয়াকিবহাল মহলের মতে, শহরের বাস টার্মিনাল, উত্তরণ আবাসিক এলাকা, নতুন জেলগেট, বিজিবি ক্যাম্প এলাকার আমতলা, সাবমেরিন গেট, সিটি কলেজ গেট, আলীর জাহাল রোড, গরুর হলদা সড়ক, হাশেমিয়া মাদরাসা গেট, খুরুশকুল রাস্তার মাথা, টেকপাড়া মসজিদ রোড়, ম্যালেরিয়া অফিস সড়ক, বার্মিজ স্কুল রোড়, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, হাসপাতাল সড়ক, ভোলা বাবুর পেট্রোলপাম্প, লালদীঘির পাড় ও গাড়ির মাঠের মুখ, হলিডে মোড়, ৬ নম্বর মাথা, সার্কিট হাউজ সড়কের ম্যাজিস্ট্রেট কলোনির সামনে, অরুণোদয় স্কুল, গোলচত্বর মাঠ, ডিসির ডাক বাংলো সড়কের মাথা, জইল্ল্যার দোকান মোড়, জাম্বুর মোড় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাথা, লাবণী মোড়, গোলদীঘির পাড়, বাজারঘাটাসহ পৌর এলাকার ৩০টির অধিক স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বেশি। ছোট-বড় গ্রুপ করে ধারালো অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শহর দাপিয়ে বেড়ায় দেড় শতাধিক ছিনতাইকারী।

গত বুধবার (২ আগস্ট) রাত ৮টার দিকে কক্সবাজার শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে ঝিলংজা ইউনিয়নের যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন পারভেজসহ তিনজন আহত হয়েছেন।

আহত পারভেজের ভাগিনা আরিফুল ইসলাম আসাদ জানান, পারভেজ তার দুই বন্ধু হামিদ ও রশিদ একটি মোটরসাইকেলে করে কলাতলীর দিকে যাচ্ছিলেন। তারা বাস টার্মিনাল এলাকায় পৌঁছালে একজনের বাঁচাও বাঁচাও শব্দ শুনে মোটরসাইকেল থামান। এরপর হেঁটে একটি অটোরিকশা লক্ষ্য করে এগিয়ে যাওয়া মাত্র ফিল্মি স্টাইলে চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ধরে হামলা করে ছিনতাইকারীরা। পরে তাদের সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

একইদিন ভোর ৬টায় শহরের ভিআইপি সড়কখ্যাত সার্কিট হাউজ রোডের ম্যাজিস্ট্রেট কলোনির সামনে টমটম থামিয়ে চার ছিনতাইকারী মিরসরাই সরকারি টেক্সটাইল কলেজ ছাত্র সামির উদ্দিনকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে সবকিছু নিয়ে যায়। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

আহত সামিরের দুলাভাই জাতীয় দলের সাবেক গোলকিপার খালেদ মোহাম্মদ আজম (বিপ্লব) জানান, তার শ্যালক মিরসরাই থেকে তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। কক্সবাজার পৌর এলাকার লালদীঘির পাড়ের বাসায় আসতে ভোরে বাস থেকে নেমে টমটমে আসার পথে ম্যাজিস্ট্রেট কলোনির সামনে ওঁত পেতে থাকা ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। তার সারা শরীরে ছুরিকাঘাতের ১৯টি চিহ্ন রয়েছে। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে চিকিৎসা চলছে তার।

এর আগে গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে কক্সবাজার বাস টার্মিনালে যাওয়ার পথে কলাতলীর বাইপাস সড়কের পাশের উত্তরণ আবাসিক এলাকার সামনে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সর্বস্ব হারান সুমি নামে এক পর্যটক। তিনি গাজীপুরে ফেরার জন্য বাস টার্মিনালে যাচ্ছিলেন।

গত মাসে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মধ্যম হ্নীলার কুতুবদিয়া পাড়ার মোহাম্মদ আলীকে তুলে নিয়ে এক লাখ ১১ হাজার টাকা কেড়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় শহরের মোহাজের পাড়ার জসিম ও শাহাদাতকে অভিযুক্ত করে থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেও এখনো কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।

কক্সবাজার পৌরসভার প্রধান সড়ক ও অলিগলি ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ সড়কবাতিই নষ্ট। সন্ধ্যা হলেই শহরজুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে। রাত ১২টার পর পুলিশ শহরের সব দোকানপাট বন্ধ করে দেয়। তখন আরও অন্ধকার হয়ে যায় চারপাশ। প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, ১৫-১৬ বছর বয়সী কিশোর থেকে ৩০ বছর বয়সী যুবকদের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সমাজকর্মী বলেন, কক্সবাজারে গত মাস ছয়েক ধরে দুর্বৃত্তায়ন পরিস্থিতি খারাপই যাচ্ছে। বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় মাত্র ৭০০ টাকা ছিনিয়ে নিতে এক বেসরকারি চাকরিজীবীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। একই এলাকায় আরও অনেকে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে জখম হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থ পুলিশ।

সুগন্ধা পয়েন্ট এলাকার ব্যবসায়ী ওবাইদুল হোছাইন জানান, সপ্তাহ দেড়েক আগে তার মার্কেটে কাজ করা মিস্ত্রি মুহাম্মদ ওসমান রাত ১০টার দিকে কাজ শেষ করে হলিডে মোড় এলাকার বাসায় ফিরছিলেন। এসময় বাচ্চার জন্য দুধ কিনতে ৬ নম্বর রাস্তার মাথায় আল-আমিন হোটেলের নিচের দোকানে যান। দুধ নিয়ে রাস্তায় উঠে পূবালী ব্যাংকের সামনে যাওয়া মাত্র কয়েকজন ছিনতাইকারী তাকে ঘিরে এলোপাতাড়ি মারধর করে সবকিছু ছিনিয়ে সটকে পড়ে। আহত ওসমানকে হাসপাতালে ভর্তির দুদিন পর বাড়ি ফেরেন। এখন সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতে তাড়াহুড়ো করেন আতঙ্কিত ওসমান।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, প্রসিদ্ধ পর্যটন নগরী হিসেবে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নির্বিঘ্নে চলাফেরার সুযোগ থাকা দরকার। কিন্তু ছিনতাই এখন ছোঁয়াচে রোগের মতো হয়ে দেখা দিয়েছে। ছিনতাই নিয়ে শুধু পর্যটক নয়, স্থানীয়রাও আতঙ্কিত এখন। পর্যটনের স্বার্থে যে কোনো মূল্যে এদের দমন করা দরকার।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, বুধবার বাস টার্মিনাল এলাকায় সামির হোসাইনরা ছিনতাইয়ের কবলে পড়ার ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র, দুটি ছুরিসহ তিনজনকে শুক্রবার ভোরে আটক করা হয়েছে। ওই ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে মামলা হয়। শুক্রবার গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা করা হয়েছে।

ওসি বলেন, ছিনতাই রোধে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। দিনে-রাতে পুলিশের পাঁচ-ছয়টি টিম শহরের নিরাপত্তায় কাজ করছে। প্রতিদিনই সন্দেহভাজদের আটক করে যাচাইয়ের পর ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। এক সপ্তাহে কমপক্ষে ২০ জন পেশাদার ছিনতাইকারী আইনের আওতায় এসেছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলামের বলেন, কক্সবাজার অন্য জেলা শহর থেকে ভিন্ন। এখানকার অপরাধের ধরন ও অপরাধীদের বিচরণও অন্য রকম। এখানকার অধিকাংশ ছিনতাইকারী আইনের চোখে অপ্রাপ্ত বয়স্ক। তবুও আমরা তাদের গ্রেফতার করি- আদালতে পাঠাই। তারা জামিনে বেরিয়ে আসে। ফের শুরু করে ছিনতাই।

তিনি বলেন, পর্যটন শহর হিসেবে হাত বাড়ালেই দোকানে দোকানে মেলে নানা দেশি ছুরিসহ ধারালো অস্ত্র। এসব দোকানে একাধিকবার অভিযানও চালানো হয়েছে। দুয়েকদিন বন্ধ থাকলেও নীরবে আবারও শুরু হয় এসব ধারালো অস্ত্র বিক্রি।

পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, শহরকে অপরাধ মুক্ত করতে হলে পুলিশের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, ব্যবসায়ীসহ অভিভাবকদের সচেতন হওয়া জরুরি। লাভের লোভ ফেলে দিয়ে ধারালো অস্ত্র বিকিকিনি বন্ধ করতে হবে। নিজের সন্তানদের ওপর নজর রাখতে হবে বাবা-মা ও অভিভাবকদের।

আরও খবর