তৌহিদুজ্জামান তন্ময় •
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্য পরিচয়ে রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে তিনজনের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেন তিন পুলিশ সদস্য। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ওই ঘটনায় মো. কামরুল ইসলাম (৩৫), রাফিজ খান (২৬) ও তুষার ইমরানের (৩১) সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। পরে গত বছরের ২১ অক্টোবর অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারদের মধ্যে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনাকারী কামরুল ইসলাম অর্থ সংক্রান্ত একটি মামলার জেরে পুলিশের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। রাফিজ ও তুষার নিয়োজিত ছিলেন ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার পর ভুক্তভোগীদের অন্য একটি সিএনজি অটোরিকশায় তুলে দেন আসামিরা। এসময় তাদের বলা হয়, ‘তোরা পেছন দিকে তাকাবি না, তাকালে গুলি করে দেবো।’
ডাকাতদলের নেতা জালাল উদ্দিন নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন জালাল হিসেবে পরিচয় দিতেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য। তার নেতৃত্বে গড়ে তোলেন সাত-আট সদস্যের একটি ডাকাতদল। মতিঝিলের ব্যাংকপাড়া থেকে মোটা অংকের অর্থ তুললে তাকে টার্গেট করে ডাকাতি করতেন এই দলের সদস্যরা। তারা ডিবি ও র্যাব পরিচয়ে ডাকাতি করতেন।
গত ১৭ এপ্রিল রংপুরের গঙ্গাচড়ায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে হাতকড়া পরিয়ে এক যুবককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় মাসুদ রানা (২৪) নামে এক পুলিশ কনস্টেবলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কনস্টেবল মাসুদ রানা রংপুর রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স থেকে প্রেষণে পঞ্চগড় পুলিশ লাইনসে কর্মরত ছিলেন।
পুলিশ জানায়, গত ৯ এপ্রিল দিনগত রাত ১টায় গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর ইউনিয়নের চওড়াপাড়া গ্রামের নুর ইসলামের বাড়িতে ঢোকেন অজ্ঞাতপরিচয় সাতজন যুবক। তারা নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয়ে নুর ইসলামের ছেলে সোনা মিয়াকে মারধর করে বাড়ি থেকে নিয়ে যান। পরে সোনা মিয়ার প্রতিবেশী সুরুজ মিয়ার মাধ্যমে অপহরণকারীরা পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন।
এভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে বিভিন্ন অপকর্ম করে চাকরিচ্যুত সদস্যরা পরে জড়াচ্ছেন অপরাধে। এসব সদস্যের অস্ত্র চালনাসহ নানান প্রশিক্ষণ থাকে। তাই সাধারণ অপরাধীর তুলনায় এরা নিপুণভাবে অপকর্মগুলো করতে পারে। আবার অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ততা থাকার কারণে কীভাবে অপরাধ করলে পার পাওয়া যাবে, সে বিষয়েও ভালো ধারণা থাকে তাদের। বিশেষ করে ভুয়া র্যাব-ডিবির দল সাজিয়ে অবৈধ ও খেলনা অস্ত্র দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শনের পর অপহরণ করে টাকা আদায় করছেন তারা।
শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরিচ্যুতদের নেতৃত্বে এমন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। তারা ১০ থেকে ১৫ জনের গ্রুপ তৈরি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে অপরাধে জড়াচ্ছেন।
এ ধরনের অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নেই কোনো আলাদা সেল। চাকরিচ্যুত হলে পরবর্তী জীবনে কোনো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন কি না অথবা সমাজে কী অবস্থায় আছেন তাদের কোনো খবর থাকে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। অপরাধ করে ধরা পড়লেই কেবল তাদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে এক লাখ তিন হাজার ১৭০ জন পুলিশ সদস্যকে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৮শ জনকে।
বাংলাদেশ গেজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যদের অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুই ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। একটি হচ্ছে- লঘুদণ্ড এবং আরেকটি গুরুদণ্ড। এখানে লঘুদণ্ড বলতে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর ৩ বিধির কয়েকটি উপবিধি এবং ৪(ক)-এর কয়েকটি উপবিধি অনুসারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লঘুদণ্ড বা বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে- তিরস্কার, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা, আর্থিক ক্ষতির ক্ষেত্রে বেতন বা আনুতোষিক থেকে আদায় করা অথবা বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে অবনমিতকরণ।
অন্যদিকে গুরুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে- নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ, বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ এবং বরখাস্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এএসপি (সহকারী পুলিশ সুপার) থেকে তদূর্ধ্ব পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলি, পদোন্নতি, শাস্তি, বরখাস্তসহ সার্বিক বিষয় দেখভাল করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়া কনস্টেবল থেকে শুরু করে পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের এসব বিষয় দেখভালের দায়িত্ব পুলিশ সদরদপ্তরের।
এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার ৬১৫টি বিভাগীয় মামলা হয়। এর মধ্যে দুই হাজার ৫৪৭টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এসব মামলায় ৪০১ জন পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত বা বরখাস্ত করা হয়। প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্যকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দণ্ড দেওয়া হয় ১২শ পুলিশ সদস্যকে।
২০২১ ও ২০২২ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কনস্টেবল থেকে উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার ১০৬ সদস্যকে বিভিন্ন অপরাধের কারণে চাকরিচ্যুত করা হয়। তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, চাকরিচ্যুতরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা যে কোনো বড় ধরনের অপরাধ করতে পারেন। তাই তাদের নজরদারিতে রাখতে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে বলা হয়েছে।
ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, অপরাধী যেই হোক তাদের বিষয়ে ডিএমপি সব সময় কঠোর। অপরাধ করে ঢাকা শহরে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ডিএমপির ৫০ থানা ও ৮ গোয়েন্দা বিভাগ অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে আদালতে সোপর্দ করে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, সমাজে যারাই অপরাধ করছে তাদেরই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত সদস্যরাও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ডিবি এরই মধ্যে চাকরিচ্যুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও আইনের আওতায় এনেছে। অর্থাৎ, সমাজে যারাই অপরাধ করুক তাদের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কঠোর অবস্থানে।
পুলিশ সদরদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে কনস্টেবল থেকে উপ-পরিদর্শক (এসআই) পর্যন্ত ৩৮২ পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
এলিট ফোর্স র্যাব থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে চাকরিচ্যুতদের অনেকেই অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। তবে র্যাব থেকে চাকরিচ্যুতদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি রাখা হয় বলে জানিয়েছেন বাহিনীর কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অপরাধ করলে র্যাবে কারও স্থান নেই। আর অপরাধের পর চাকরিচ্যুত করা হয়। চাকরিচ্যুতির পরেও প্রত্যেকের ওপর নজরদারি রাখা হয়। যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-