নির্বিঘ্নে কক্সবাজারে ট্রেন নিতে লাগবে ২১,০০০ কোটি টাকা

রাজীব আহাম্মদ, ঢাকা ও তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম

কক্সবাজার পর্যন্ত নির্বিঘ্নে ট্রেন চলাচলে আরও ২১ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে। ৯২ বছরের পুরোনো ৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথ পুনর্নিমাণে প্রয়োজন প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। সমবয়সী জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু পুনর্নির্মাণে প্রয়োজন প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। ২০২৯ সালের আগে নির্মাণ সম্ভব না হওয়ায়, কক্সবাজারে ট্রেন নিতে পুরোনো সেতু সংস্কার করা হচ্ছে। এ জন্য আজ থেকে আগামী তিন মাস বন্ধ থাকবে সেতুটি।

২০১০ সালে অনুমোদিত দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণে প্রথমে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। পরে তা বেড়ে হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। এতে খরচ হচ্ছে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। মিয়ানমারের আপত্তিতে ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার-ঘুমধুম অংশের কাজ শুরু হয়নি।

রেলওয়ের ঘোষণা অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ চালু হবে। প্রথমবারের মতো ট্রেন যাবে পর্যটননগরীতে। প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান সমকালকে বলেছেন, সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। কালুরঘাট সেতু উপযোগী হলে ট্রেন চলবে। দুই মাস লাগতে পারে সেতুটি ট্রেন চলাচলের উপযোগী করতে।

রেল সূত্র জানায়, অক্টোবরে কক্সবাজারে ট্রেন যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময় পাওয়ার ওপর উদ্বোধনের দিনক্ষণ নির্ভর করছে। জনবল, ইঞ্জিন ও বগি সংকটে শুরুতে মাত্র এক জোড়া ট্রেন চালানোর প্রস্তাব করেছে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয়। অর্থাৎ একটি ট্রেন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার যাবে। দুটি বিকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, ট্রেনটি রাতে ঢাকা থেকে যাত্রা করে পরের দিন সকালে কক্সবাজারে পৌঁছাবে। সেই ট্রেন পরের দিন ঢাকায় ফিরবে।

তাতেও বিপত্তি রয়েছে, ফৌজদারহাটে বাইপাস লাইন নির্মিত না হওয়ায়, ঢাকা থেকে ট্রেন চট্টগ্রামে নিয়ে দোহাজারী অভিমুখে ইঞ্জিন ঘোরাতে হবে। এতে আধাঘণ্টার মতো বাড়তি সময় লাগবে।

রেলের একজন কর্মকর্তা জানান, সেপ্টেম্বরে বা অক্টোবরে উদ্বোধন হলেও ডিসেম্বরের আগে যাত্রীবাহী ট্রেন চালু কঠিন। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম ছয়টি আন্তঃনগর ট্রেন চলে। সেগুলো কক্সবাজার পর্যন্ত বর্ধিত করা সম্ভব। তবে এর জন্য জনবল, ইঞ্জিন-বগি প্রয়োজন। এসব এই মুহূর্তে নেই। তাই সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার রেলপথের সুফল পেতে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।

১৯৩১ সালে নির্মিত কালুরঘাট সেতুতে একইসঙ্গে ট্রেন ও গাড়ি চলছে ৬২ বছর ধরে। ট্রেন চলার সময় গাড়ি বন্ধ রাখা হয়। এক লেনের সড়কে উভয় দিক থেকে একই সময়ে গাড়ি চলাচল করতে পারে না। বোয়ালখালী থেকে চট্টগ্রামমুখী গাড়ি চলাচলের সময় চট্টগ্রাম থেকে বোয়ালখালীমুখী গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। সেতুতে বর্তমানে দিনে দুটি যাত্রীবাহী এবং একটি পণ্যবাহী রেলগাড়ি চলে।
রেলের পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা সমকালকে বলেছেন, সংস্কার কাজের জন্য আজ মঙ্গলবার থেকে তিন মাসের জন্য বন্ধ থাকবে কালুরঘাট সেতু। তবে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন নিতে, সেতুটিকে দুই মাসের মধ্যে রেল চলাচলের উপযোগী করার চেষ্টা রয়েছে। বাকি কাজ পরে করা হবে।

আগেও দুই দফা বড় সংস্কার হয়েছে কালুরঘাট সেতুতে। রেলের ভাষ্য অনুযায়ী, নতুন নির্মিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার ট্রেন চালানো সম্ভব। চীন থেকে কেনা নতুন বগিতে তৈরি ট্রেন চালানো হবে এ রুটে। এসব ট্রেনের ২০ এক্সেল লোডের ট্রেন কালুরঘাট সেতুতে চলার উপযোগী নয়। ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটি সংস্কারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সঙ্গে চুক্তি করেছে রেলওয়ে।

আবু জাফর মিঞা বলেছেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) সমীক্ষা করেছে। পুরো সেতু নয়, ওপরের ডেকিং পুনর্নির্মাণ করা হবে। গার্ডারের কিছু কড পরিবর্তন করা হবে। সেতুর ওপরের যে কার্পেটিং করা ট্রাস প্লেট দিয়ে যানবাহন চলাচল করে, তা তুলে নতুন প্লেট বসানো হবে। সংস্কার শেষে বড় ইঞ্জিনের ট্রেন ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহেদ হোসেন জানান, সেতু বন্ধ হওয়ায় যানবাহন পারাপারে ফেরি চালু হয়েছে। গত ২১ জুলাই পরীক্ষামূলক পারাপার করা হয়।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ৩২১ কিলোমিটার রেলপথের ১২৪ কিলোমিটার আগে থেকেই ডাবল লাইনের ছিল। বাকি পথ গত ১৮ বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকায় ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়েছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ সিঙ্গেল লাইন নির্মাণের খরচসহ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেনের গতি বাড়াতে আরও ২১ হাজার কোটি টাকা লাগবে।

গত ৮ মে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়। সভার নথি অনুযায়ী, বৈদেশিক অর্থায়ন পাওয়ার সুবিধার্থে প্রকল্পটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের অনুমোদিত নতুন প্রকল্পের তালিকায় রাখা হয়েছে। এই রেলপথ ডুয়েলগেজে উন্নীত হলে ব্রডগেজ ট্রেন ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে চালানো সম্ভব। বর্তমানে সর্বোচ্চ ৪৮ কিলোমিটার গতিতে চলে। ৭ হাজার ৭৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ৪ হাজার ৬৫ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ প্রয়োজন। ঋণ পেলে ২০২৭ সালের জুনে নির্মাণ সম্পন্ন হবে। রেলের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেছেন, অর্থায়নের সন্ধান চলছে।

প্রকল্পটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে, আগামী চার বছরে সম্পন্নের সম্ভাবনা ক্ষীণ। বহু আগে উদ্যোগ নিয়েও এখনও কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কূলকিনারা করা যায়নি। কামরুল আহসান সমকালকে বলেছেন, কোরিয়ান ইডিসিএফের অর্থায়নে কালুরঘাট সেতু হবে। সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পরামর্শক।
আগেও দুই দফা সমীক্ষা হয় কালুরঘাট সেতুর। প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, ২০১২ সালের সমীক্ষা বাতিল করে চার বছর পর ফের সমীক্ষা করে ইডিসিএফ। ট্রেন চলাচলে ডুয়েলগেজ সিঙ্গেল লাইন রেলপথ এবং গাড়ির জন্য দুই লেনের সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করে সংস্থাটি।

ওই সমীক্ষায় পানি থেকে সেতুর উচ্চতা (নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স) ধরা হয় ৭ দশমিক ৬২ মিটার। ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য ২০১৮ সালের আগস্টে একনেকে উত্থাপন করা হয়। অনুমোদন না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক সভা ট্রেন এবং গাড়ির জন্য পৃথক সেতুর নকশা উপস্থাপন করতে বলে। ২০২০ সালে অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী রেল কাম রোড সেতু নির্মাণের অনুশাসন দেন। তবে নদী রক্ষায় নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ১২ দশমিক ২ মিটার রাখতে নির্দেশ দেন।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, কোরিয়ান পরামর্শক পদ্মা সেতুর মতো দ্বিতল সেতু নির্মাণসহ চারটি বিকল্প মডেল সুপারিশ করে। গত বছরের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী এক্সট্রা ডোজ রেল কাম রোড সেতু নির্মাণে সম্মতি দেন। যাতে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনের রেলপথ এবং দুই লেনের সড়ক থাকবে। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে কাজ শুরু হয়ে ২০২৯ সালের জুনে সম্পন্ন হবে।

রেল কর্মকর্তারা জানান, নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স অর্থাৎ উচ্চতা বাড়ায় সেতুর দৈর্ঘ্য অনেক বাড়ছে। এতে ব্যয় ১২ গুণ বেড়েছে। এই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে রেল মন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠক হয়েছে। গত মাসের প্রথম সপ্তাহের বৈঠকটি স্থগিত হওয়ায় আলোচনা থমকে আছে।

আরও খবর