ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, মেরে ফেলতে পারেনি

উদিসা ইসলাম •

  • ‘একজন মানুষও কখনো হয়ে যায়
  • অতুলন মহার্ঘ প্রতীক
  • তখন আমরা সবাই তাকে পতাকার মত ওড়াই’

হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একান্ত মানচিত্র বাংলার’ শিরোনামে এই কবিতাটি ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অগণন স্বপ্ন নিয়ে, সাহসে বলীয়ান হয়ে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রটি জন্ম দিয়েছিলেন যে শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁকে মাত্র চার বছরের মাথায় হত্যা করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলেও তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে ঘাতকেরা মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, তাঁর লালিত সোনার বাংলা এমনকি যে আগস্ট মাসকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিল, সেই আগস্ট ‘শোকের মাস’ হিসেবে পালিত হয় বাংলার মানুষের হৃদয়ে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন পুত্র— বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, একমাত্র সহোদর বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, কৃষকনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, যুবনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বেবী সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু, আব্দুল নঈম খান রিন্টুসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে ঘৃণ্য ঘাতকরা হত্যা করে। রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল এবং কর্তব্যরত পুলিশের বিশেষ শাখার এএসআই সিদ্দিকুর রহমান নিহত হন। ঘাতকদের কামানের গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরে একটি পরিবারের বেশ কয়েকজন হতাহত হন।

গবেষকরা বলছেন, সপরিবারে হত্যার পরে পুরো দেশ থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চালানো হলেও সেটি শেষ পর্যন্ত সফলভাবে করতে পারেনি ঘাতকেরা। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার পথে পাড়ি দেন দীর্ঘ সময়। কী ছিল সেই পরিকল্পনায়, কী ছিল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায়।

কী ছিল সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা? ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মুক্ত স্বদেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরে ২০২২ সালের শোক দিবসের বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এই ভাষণটা ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা।’

১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ— ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের যুবক যারা আছে, তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ তোমাদের মোবারকবাদ জানাই— তোমরা গেরিলা হয়েছো তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।’

গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে— এই আমার সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য। আমি যেন এই কথা চিন্তা করেই মরতে পারি। এই আশীর্বাদ, এই দোয়া আপনারা আমাকে করবেন।’

বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হত্যা করা যায় না উল্লেখ করে অধ্যাপক ও গবেষক রতন সিদ্দিকী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালে হত্যা করা হয়েছে। এতে তাঁর দেহবসান হয়েছে। চিন্তা আদর্শ চেতনা অবসান হয়নি। সেটি বরং অনেক বেশি কার্যকর আমাদের বর্তমান সমাজ বাস্তবতায়।’ সেটা ঘাতকেরা করতে চেয়েছিল, সেজন্য অনেক ধরনের ষড়যন্ত্র করেছিল উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘তারপরেও পারেনি। কারণ যা ধ্রুব, যা নিত্য তা অনিবার্যভাবে প্রকাশিত হবেই। সূর্য আড়াল করে রাখা যায়, কিন্তু আড়ালে রাখা চিরকাল সম্ভব না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ও রক্তের উত্তরাধিকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সেই সূর্য বের করে আনতে পেরেছেন।’

ঘাতকদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধ্বংস করার চক্রান্ত এবং পরবর্তীকালে তা রুখে দিতে বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের প্রচেষ্টার বিষয়ে বলতে গিয়ে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, ‘যে আদর্শের জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন, যেগুলো স্বাধীন দেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে, সেগুলো বাতিল করার মধ্য দিয়ে ঘাতকেরা তাদের উদ্দেশ্য দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট করেছিল। পৃথিবীর আর কোথাও এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে না, যেখানে কোনও দেশ তার মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাওয় রাষ্ট্রের প্রস্তাবনা সংবিধান থেকে মুছে দেবে। ঘাতকেরা সেটাও করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে যে শুধু শারীরিকভাবে হত্যা করেছে তাই নয়, তারা তাঁর আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করতে চেয়েছে। কিন্তু ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। যে আদর্শের জন্য বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তা পুনরুদ্ধার করেছেন।’

আরও খবর