মিয়ানমারের মদদেই সক্রিয় আরসা, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলতি বছরে ৪৯ খুন

সুজাউদ্দিন রুবেল •

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দিন দিন বেড়েই চলেছে অস্থিরতা। বিশেষত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কিংবা মিয়ানমারবিরোধী কোনো ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা হলে বা কোনো প্রতিনিধিদল পরিদর্শনে এলেই ক্যাম্পে খুনোখুনি ও অরাজকতা বেড়ে যায়। পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরেই এসব ক্যাম্পে খুন হয়েছেন ৪৯ জন।

সাধারণ রোহিঙ্গাদের দাবি, মিয়ানমারই এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) দিয়ে এসব ঘটাচ্ছে তারা।

আর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) বলছে, ক্যাম্পে সক্রিয় থাকা মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

গত ৬ জুলাই কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্প পরিদর্শনে যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম আসাদ আহমাদ খানের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। দলটি কুতুপালং ১ নম্বর পশ্চিম ক্যাম্পের এ/১ ব্লক পরিদর্শনকালে একই ক্যাম্পের এ/৯ ব্লকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় এবাদুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গাকে। তিনি ওই ব্লকের উপ-প্রধানের (সাব মাঝি) দায়িত্ব পালন করতেন।

পরদিন ৭ জুলাই (শুক্রবার) ভোরে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীর ক্যাম্প-৮ ইস্টের পাহাড়ি এলাকায় আরএসও এবং আরসার সন্ত্রাসীদের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। ঘটনাস্থলে এপিবিএন পৌঁছালে পালিয়ে যায় দুই গ্রুপের সদস্যরা। তবে গোলাগুলিতে প্রাণ যায় পাঁচজনের।

এপিবিএন জানায়, নিহত পাঁচজনই আরসার সদস্য। একই ক্যাম্প থেকে বিকেলে আরও এক রোহিঙ্গার গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

সাধারণ রোহিঙ্গাদের দাবি, ক্যাম্পে কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। তারা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এ জন্য তারা সব সময় ভয়ে থাকেন। প্রশাসনকে জানালে গলা কেটে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। ক্যাম্পে অস্থিরতা তৈরি করেছে আরসা। মিয়ানমারই এসব গ্রুপকে দিয়ে ক্যাম্পে অস্থিরতা তৈরি করছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যত খুন

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২১ জুলাই পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৮২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি বছরেই ৪৯ জন, যাদের মধ্যে ৩২ জনই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনায় জড়িত নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক। তারা নানাভাবে অপরাধ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী হতে কাজ করেছেন।

শুধু গত এক বছরে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে ১৬৮ জনকে গ্রেফতার এবং চার শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

এর বাইরেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের আলোচনা ঠেকাতে অনেক ক্যাম্পে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২২২টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ৬৩টি নাশকতামূলক বা ইচ্ছে করে লাগানো হয়েছে।

এছাড়াও গত ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা মুহিবুল্লাহকে। তিনি রোহিঙ্গা অধিকারের পক্ষে কথা বলে প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। এ কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে। এর নেপথ্যের পরিকল্পনাকারী বলা হয়েছে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরসাপ্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার ওরফে জুনুনিকে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় আরসা

শুক্রবার আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের অন্যতম সামরিক কমান্ডার হাফেজ নুর মোহাম্মদসহ আরসার ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে এ ছয়জন খুন ও অপহরণসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত থাকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে।

তারা জানিয়েছে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে সক্রিয় রয়েছে আরসার ৪৫০ সন্ত্রাসী। এরা গহীন পাহাড়ে আস্তানা তৈরি করে টর্চারসেল গড়ে তুলে অপহরণ ছাড়াও নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় এমনকি হত্যার পর মরদেহ গুম করে আসছে।

নুর মোহাম্মদের নেতৃত্বে আরসার ৩০-৩৫ জন সদস্য কুতুপালং ক্যাম্প ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তারা পার্শ্ববর্তী দেশ হতে দুর্গম সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করে।

নুর মোহাম্মদ তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে খুন, অপহরণ ও গুমের ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি করতো। চাঁদার অর্থ না পেলে অপহরণ, শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতনসহ মুক্তিপণ আদায় করতো। মুক্তিপণ না পেলে খুন করে গহীন পাহাড়ে অথবা জঙ্গলে লাশ গুম করতো।

এই নুর মোহাম্মদের নেতৃত্বেই ক্যাম্পে হেড মাঝি শফি উল্লাহ্ হত্যাকাণ্ড, সালাম হত্যাকাণ্ড, সলিম হত্যাকাণ্ড, মালেক হত্যাকাণ্ড, হাবুইয়া হত্যাকাণ্ড ইমান হত্যাকাণ্ড, আবুল মুনসুর হত্যাকাণ্ড, সালেহ্ হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক একজন মহিলার ঘরে প্রবেশের সময় মহিলা বাধা দিলে তাকে গুলি করে হত্যা এবং সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত ছয় জন হত্যাসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য মিলিছে।

গ্রেফতার আরসার সদস্য মো. হোসেন জোহার হেডমাঝি আবু তালেবকে গুলি করে হত্যা, সাবমাঝি সৈয়দ হোছেনকে গুলি করে চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা ও শফিকুর রহমানকে গুলি করে হত্যার প্রধান সহযোগী হিসেবে জড়িত ছিল।

ফারুক হারেস আরসার প্রহরী দলের প্রধান সমন্বয়কারী এবং ‘টর্চারসেল’-এর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো। তার ৭-৮ জনের একটি ‘নেট গ্রুপ’ রয়েছে, যারা নিয়মিত ক্যাম্পের প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতো এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের কাছে রিপোর্ট করতো।

আর মনির আহাম্মদ, নূর ইসলাম এবং ইয়াছিন পাহাড়ে অবস্থিত গোপন আরসা ঘাঁটির নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতো। যেখানে অপহরণ করে নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় করা হয়।

প্রশাসনের পাশাপাশি ক্যাম্পের এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত স্থানীয় বাসিন্দারাও। ক্যাম্পের অপরাধ দমনে যৌথ অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি স্থানীয় জনপ্রতিনিধির।

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

উখিয়ার কুতুপালংয়ের রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপগুলো যেভাবে ক্যাম্পে অস্থিরতা তৈরি করছে, তাতে স্থানীয়রাও আতঙ্কে রয়েছেন। আমরা চাই, ক্যাম্পে খুনোখুনিসহ সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ হোক। প্রয়োজনে সব বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান চালিয়ে ক্যাম্প থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে আইনের আওতায় আনা হোক।’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহামুদুল হক চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পে সংঘটিত অপরাধ কর্মকাণ্ডে মিয়ানমারের মদদ রয়েছে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা, আইস আনাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। প্রত্যাবাসন ঠেকানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আরসা অস্ত্র সংগ্রহ করে ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। অপরাধ সংঘটিত করে ভারী অস্ত্রগুলো আবার তারা লুকিয়ে রাখছে। ক্যাম্পে আরসার ৪০০ থেকে ৪৫০ সদস্য রয়েছে। তাদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।

আরও খবর