ইমরান আল মাহমুদ, কক্সবাজার জার্নাল:
বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে সর্বশেষ রোহিঙ্গার ঢল আসে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এরপর থেকে মানবতার দিক বিবেচনা করে আশ্রিত ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সহায়তায় কাজ করছে দেশি বিদেশি শতাধিক সংস্থা। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার দায়িত্বে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ক্যাম্পে দায়িত্ব দেওয়া হয় ৮, ১৪ ও ১৬ আর্মড পুলিশের তিনটি ব্যাটালিয়নকে।
রোহিঙ্গা আগমনের ৬ বছর আগামী ২৫ আগস্ট পূর্ণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু দিন দিন হিংস্র হয়ে উঠছে রোহিঙ্গাদের বিশাল একটি অংশ। সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি সহ মাদক, গুম, খুন,অপহরণ ও মানবপাচারের মতো অপরাধে জড়িত হচ্ছে তারা। এসব অপরাধে মদদ দিচ্ছে উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় কিছু অপরাধী লোকজন। বর্তমানে অস্থির হয়ে উঠেছে পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্প। কয়েকদিন পরপরই ঘটছে খুন ও গোলাগুলির ঘটনা। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে সশস্ত্র দুই গ্রুপের রোহিঙ্গা দুষ্কৃতকারীরা। তাদের মধ্যে পুলিশের তথ্যে উঠেছে এসেছে আরসা ও আরএসও নামক দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপের ক্যাম্পে সক্রিয় উপস্থিতি। সর্বশেষ গত ৭ জুলাই ক্যাম্প-৮ এ গোলাগুলিতে ৫ রোহিঙ্গা নিহতের ঘটনা ঘটে।
মাদক,খুন, আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অপহরণের ঘটনা।
গত ২ জুলাই ক্যাম্প-১৩ থেকে ৬জন কিশোরকে অপহরণ করে নিয়ে যায় একটি চক্র। অপহরণের পাঁচদিন পর ৭জুলাই টেকনাফ উপজেলার লম্বরী পাড়া এলাকার দুর্গম স্থান থেকে অপহৃত তিনজন ভিকটিম উদ্ধার করে ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদস্যরা। এ ঘটনায় জড়িত ৯জনকে গ্রেফতারও করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো,টেকনাফের নুরুল আমিন (৩২),মো. ফয়সাল (১৮) শফিকুল (১৮),সাইফুল ইসলাম (২২), মিজানুর রহমান
(১৮), আব্দুর রহমান (১৭) মোহাম্মদ পারভেজ (১৪) এবং দুইজন রোহিঙ্গা মো. মোবারক (১৭) ও মো. আমিন (১৭)। এরপরও থেমে যায়নি অপহরণকারীদের দৌরাত্ম্য। গত ৮ জুলাই উখিয়ার ক্যাম্প-১৯ থেকে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে টেকনাফ নিয়ে যায় দুই রোহিঙ্গাকে। এরপর শুরু হয় অপহরণের নীলনকশার ধাপ।
উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ চক্রের প্রধান টার্গেট প্রথমে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের টেকনাফ দুর্গম স্থানে রেখে এরপর কৌশলে মিয়ানমারের শামিলা বা আকিয়াবে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর শুরু হয় নির্যাতন। আদায় করা হয় মোটা অংকের টাকা। বিষয়টি ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ৮ এপিবিএন কে জানালে শুরু হয় অভিযান। দীর্ঘ চেষ্টার পর অপহরণের শিকার একজনকে উদ্ধার সহ তিনজন অপহরণকারীকে গ্রেফতার করা হয়। বৃহস্পতিবার(২০ জুলাই) দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে অপহরণের বিষয়ে ৮ এপিবিএন সহকারী পুলিশ সুপার( মিডিয়া এন্ড অপস) মো. ফারুক আহমেদ জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অপহরণের বিষয়টি ৮এপিবিএন আমলে নিয়ে অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফরের নির্দেশে অভিযান পরিচালনা করা হয়। শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে টেকনাফের সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে খুঁজাখুঁজি করার পরে নানা কৌশল অবলম্বন করে একজনকে উদ্ধার সহ তিনজন অপহরণকারী গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
গ্রেফতারকৃতরা হলো,উখিয়া থেকে চক্রের সদস্য ক্যাম্প-২০ এক্সটেনশনের এইচ-১ ব্লকের ফয়েজউল্লাহর ছেলে এনামউল্লাহ (২১),টেকনাফ নতুন পল্লান পাড়া এলাকার মৃত নুর মোহাম্মদের ছেলে কলিম উল্লাহ(৩৫) ও টেকনাফ দক্ষিণ লম্বরীপাড়া থেকে সাইফুল ইসলামের ছেলে তারিকুল ইসলাম(১৯) কে গ্রেফতার করা হয়।
পরবর্তীতে মায়ানমারে পাচারকৃত ভিকটিম কেফাতউল্লাহকে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নাফ নদীর তীরে আনা হলে সেখান থেকে বৃহস্পতিবার(২০ জুলাই) ভোরে তাকে উদ্ধার করা হয়।
পুলিশের তথ্যে উঠে এসেছে মানবপাচারের বিভিন্ন প্রক্রিয়া বা ধাপের তথ্য। তথ্যানুযায়ী,১ম ধাপে অপরাধ চক্রটির প্রথম গ্রুপ ভিকটিমদের শনাক্ত করে করে তুলনামূলক অধিক মজুরিতে বিভিন্ন কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রাখে। দ্বিতীয় ধাপে,চক্রের ২য় গ্রুপ ভিকটিমদের টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন নির্জন স্থানে বিশেষ করে দক্ষিণ লম্বরি নামক স্থানে লুকিয়ে রাখে। তৃতীয় ধাপে,এ চক্রের সদস্যরা সুবিধা জনক সময়ে লুকিয়ে নাফ নদীর পাশে নিয়ে যায় ও রাতের অন্ধকারে নৌকা যোগে মায়ানমারের (শামিলা বা আকিয়াবে) পাঠায়। ৪র্থ ধাপে, চক্রের মায়ানমারের নাগরিকরা তাদের আটক রেখে নির্যাতন করে ভিকটিমদের আত্মীয়- স্বজনদের সাথে সরাসরি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম( ইমু বা হোয়াটসঅ্যাপ) অথবা চক্রের বাংলাদেশে অবস্থানরত স্থানীয়দের দিয়ে বিকাশে বা নগদে টাকা গ্রহণ করে। চক্রের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের নাম্বারে টাকা গ্রহণ করে। ৫ম ধাপে, বিকাশে টাকা ক্যাশ আউট করে বা নগদে সংগ্রহ করে একত্র করে মোটা অংকের টাকা জমা করে ৬ষ্ঠ ধাপে, টেকনাফ বন্দরে টাকা মায়ানমারের মুদ্রায় রূপান্তর করে অবৈধভাবে টাকা অপরাধ চক্রের মায়ানমারের নাগরিকদের পাঠায়। ৭ম ধাপে,পাচারকৃত ভিকটিমদের মায়ানমার থেকে নৌকাযোগে নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় অথবা খুন করে।
তবে, ক্যাম্পে খুন, মাদক পাচার ও অপহরণের ঘটনায় উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিকটবর্তী রাজাপালং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন,”যৌথ অভিযান পরিচালনা করে চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে”
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-